জাবিতে ভর্তি জালিয়াতিতে দুই ছাত্রলীগ নেতার নাম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সি ইউনিট’ কলা ও মানবিকী অনুষদের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তির চেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পরিচয়ধারী দুই নেতার নাম এসেছে। এর মধ্যে একজন মোবাইল ফোনে সাড়ে চার লাখ টাকার বিনিময়ে ভর্তির নিশ্চয়তা দিয়েছেন। অপরজন দুই জনকে মৌখিক পরীক্ষায় যাওয়ার সময় সতর্ক করেছেন।
ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির চেষ্টার অভিযোগে আটক একজনের মোবাইল ফোনে কথোপকথন এবং ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ের সূত্র ধরে এই বিষয়টি জানা গেছে।
এর মধ্যে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের সূত্র ধরে জানা যায়, খিলক্ষেত থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পরিচয়ধারী একজন দুই জনকে ভর্তির নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তবে বর্তমানে ছাত্রলীগের এই থানা কমিটি নেই।
আর ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিংকারী ছাত্রলীগ নেতার নাম মেহেদী হাসান রুমি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ রহমান হল ছাত্রলীগের পদাধিকারী।
এই দুই জনের মধ্যে খিলক্ষেত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নামধারী নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেছে এবং তিনি দাবি করেছেন, জালিয়াতির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই। যে দুই জন ধরা পড়েছেন, তাদের একজন তার পূর্ব পরিচিত এবং তিনি তাকে সতর্ক করেছেন মাত্র।
ধরা পড়া দুই শিক্ষার্থীর নাম হিমাদ্রী সাহা এবং রাশেদুল হাসান রাজন। তাদেরকে পুলিশে দিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
যেভাবে ধরা পড়লেন দুই পরীশিক্ষার্থী
প্রক্সি দিয়ে লিখিত পরীক্ষায় পার পেয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন সাক্ষাৎকার বা মৌখিক পরীক্ষায় ধরা পড়ে যান হাতের লেখা না মেলায়। কিন্তু হিমাদ্রী সাহা ও রাশেদুল হাসান রাজনের হয়ে যারা লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তাদের হাতের লেখা নকল করে এসেছিলেন মৌখিক পরীক্ষায়। সেবার উৎরেও যান। কিন্তু তাদের মোবাইল ফোনের কথোপকথন এবং ম্যাসেঞ্জারে কথাবার্তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যান এই দুই জন।
হিমাদ্রী সাহা ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এর সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারে শিক্ষার্থী। নেত্রকোণা সরকারি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী থাকেন রাজধানীর জিগাতলা এলাকায়। ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে তার নাম আছে ৩৩ তম স্থানে।
অপরজন ঢাকা কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের রাশেদুল হাসান রাজন। নটরডেম কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী তিনি। তিনিও জিগাতলাতে থাকেন এবং ‘সি’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে তার নাম আছে ৭৬ তম স্থানে।
গত ১৩ নভেম্বর দুপুরে রাজনের বিষয়ে একটি তথ্য পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফোন করে জানান, রাজন মানবিকী অনুষদে প্রক্সির মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষার পর ১২ নভেম্বর ভাইভা দিয়ে গেছেন কিন্তু ধরা পড়েননি। তার বন্ধু হিমাদ্রী ১৪ নভেম্বর ভাইভা দিতে আসবেন। তিনিও প্রক্সির মাধ্যমে চান্স পেয়েছেন। তবে যিনি এই তথ্য জানিয়েছিলেন তিনি এই দুটি নাম ছাড়া আর কোন তথ্য দিতে পারেননি।
পরে হিমাদ্রী মোবাইল ফোন নম্বর যোগাড় করে তার সঙ্গে কথা হয় এবং সকালে ভাইবার আগে দেখা করার কথা নিশ্চিত করেন তিনি। তবে হিমাদ্রী দেখা করেননি। পরে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, সকাল ১০ টার দিকে ভাইবা দিয়েছেন তিনি। তাকে ভাইবা বোর্ডে আটকানো হয়নি।
এরপর একাধিকবার দেখা করার প্রস্তাব দিলও হিমাদ্রী রাজি হননি। পরে সরাসরি ভর্তির সময়ে ক্যাম্পাসে এসে দেখা করতে চাওয়ার কথা জানান।
এরই মধ্যে তিনটি অডিও রেকর্ড এর সন্ধান পাওয়া যায় যেখানে তাদের প্রক্সির স্বীকারোক্তি, যার মাধ্যমে কাজ করা হয়েছে, টাকার পরিমাণ এবং ভাইবা বোর্ডে আসতে তাদের ভয় পাওয়ার কথোপকোথন রয়েছে।
অডিও রেকর্ডের কথোপকোথন দেখা যায়, তারা দুই জনেই খিলক্ষেত থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পরিচয় দেয়া একজনের মাধ্যমে কাজ করিয়েছেন। যেজন্য তারা সাড়ে চার লাখ টাকা করে দিয়েছেন। এবং সেই ছাত্রলীগ নেতা তাদের ভর্তির নিশ্চয়তাও দিয়েছেন।
অবশ্য ছাত্রলীগের নেতারা জানান, তাদের খিলক্ষেত কমিটি নেই। তাই এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দেয়া ব্যক্তি অন্য কেউ অথবা আগের কমিটির কোনো নেতা হবেন।
এই কথোপকথনের রেকর্ডে জানা যায়, ভাইভা দেয়ার আগে হিমাদ্রী ধরা পড়ার কিছুটা ভয় পাচ্ছিলেন। কারণ আগের দুইদিনে ভাইভা বোর্ড থেকে নয়জনকে আটক করা হয়েছিল।
হিমাদ্রী আরও বলেন, শুধু তারাই নন। আরও অনেকেই আছেন। যাদের সিরিয়াল আগে শুধুমাত্র তারাই ধরা পড়েছেন। শেষের দিকের অধিকাংশই ধরা পড়েননি। অন্যরা কার মাধ্যমে কাজ করেছেন জানতে চাইলে তিনি জানেন না বলে জানান।
অন্যদিকে রাজন খুবই আনন্দিত যে, ভাইবা বোর্ডের শিক্ষকরা তাকে আটক করতে পারেননি। তবে একটা ভয় তার মনের মধ্যেও ছিল। তিনি বারবার জানতে চাচ্ছিলেন, ‘কোন সমস্যা হবে ভাই?’
১৯ নভেম্বর চূড়ান্তু মেধাতালিকা প্রকাশ করলে দেখা যায় হিমাদ্রী ১২ তম হয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ এবং রাজন ৫৮ তম হয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন। বিষয়টি পরদিন সকালে অনুষদ ডিন মোজাম্মেল হককে জানানো হলে তিনি প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ^াস দেন। এবং তাদের ওএমআর শিটসহ একটি সতর্ক বার্তা বিভাগে দুটিতে পাঠিয়ে দেন।
ভর্তির তৃতীয় দিন (বুধবার) দুপুরে তারা দুজন দুই বিভাগে ভর্তির জন্য যান। পূর্ব সতর্কতা থাকায় বেশ গুরুত্ব দিয়েই যাচাই বাছাই করা হয় তাদের। এক পর্যায়ে হাতের লেখা থেকে শুরু করে কথা বার্তা সবকিছুতেই গরমিল দেখতে পান শিক্ষকরা।
তারপরও রাজন দাবি করেন, তিনি নিজেই পরীক্ষা দিয়েছেন। এজন্য তাকে একই প্রশ্নে আবার ও পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেখানে তিনি মাত্র পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। যেখানে ভর্তি পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ৬৮.৪। এরপর দুজনকেই পাঠানো হয় ডিন অফিসে।
প্রথমে পাঠানো হয় রাজনকে। সেখানে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, হিমাদ্রী এবং তিনি খুবই ভালো বন্ধু এবং জিগাতলাতে একসাথে থাকেন। হিমাদ্রী এখন কোথায় জানতে চাইলে রাজন বলেন, ‘মনে হয় ও জার্নালিজমে ভর্তি হয়ে চলে গেছে।’
একটু পরেই হিমাদ্রীকে নিয়ে আসা হয় সেখানে। তখন হিমাদ্র্রী শুরুতে রাজনকে চেনার কথা অস্বীকার করেন। দাবি করেন, তিনি একাই এসেছেন ভর্তি হতে। পরে এক পর্যায়ে হিমাদ্রী স্বীকার করেন যে রাজন তার ছোটবেলার বন্ধু।
ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে হিমাদ্রী সব কিছু অস্বীকার করে বলেন, তারা নিজে পরীক্ষা দিয়েছেন। তারা কেন স্বীকার করবে।
পরে হিমাদ্রীর মোবাইল ফোন থেকে তার ম্যাসেঞ্জারেই পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ও স্যার এফ রহমান হল ছাত্রলীগের উপ-দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক মেহেদী হাসান রুমির সঙ্গে তার কথোপকোথন।
তার পরেও রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত কোন কিছু স্বীকার না করায় অনুষদ ডিন এবং ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আতিকুর রহমান তাদের কাগজপত্র রেখে ছেড়ে দেন এবং বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) ১২ টার সময় আসতে বলেন।
বেলা দুইটার দিকে তারা এলে পরীক্ষা কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বসেন এবং সবাই একমত হন, তারা প্রক্সির মাধ্যমে ভর্তি হয়েছেন। তবে তারা তা অস্বীকার করেন।
বিকালে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেখান থেকে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তাদেরকে পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগের মামলা দিয়ে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমাদের সবার কাছে মনে হয়েছে তারা জালিয়াতি করে ভর্তি হয়েছে। কারণ তাদের হাতের লেখা ও পরীক্ষায় অনেক গরমিল দেখা গেছে। সেই সাথে ফোন কলের রেকর্ড ও এসএমস ও আছে। তাই আমার তাদের প্রক্টরের হাতে তুলে দিয়েছি।’
ছাত্রলীগ নেতা রুমির সঙ্গে দুই ভর্তিচ্ছুর যে কথা হয়
হিমাদ্রীর মোবাইল ফোনে পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসান রুমির কথোপকথন। রুমি হিমাদ্রীকে লিখেন, ‘চারটা কিন্তু ধরছে। লেখাটা ভালো করে শিখছস?’
হিমাদ্রীর জবাব ‘জানি, হুম।’
আর রাজনকে ওই ছাত্রলীগ নেতা লেখেন, ‘তুই ঢাকায় আয়, পেপারগুলো সব বুঝে নে (নিরাপত্তা হিসেবে যে সার্টিফিকেট জমা রাখে চক্রের সদস্যরা), জাবিতে ভাইবার কিছু কাজ আছে।’
রুমির দাবি তিনি জড়িত নন
ম্যাসেঞ্জারে এই চ্যাটিংয়ের বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ নেতা রুমির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘ও (হিমাদ্রী) আমার ভালো বন্ধু। তাই আমি বিষয়টি ওকে জানিয়েছি সতর্ক করার জন্য। বিশ্বাস করুন ভাই, আর কিছু জানি না। দরকার হলে আপনারা আরও তদন্ত করুন। আর ও এতোটা ভালো ছাত্র নয় যে সে পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাবে।’
পুলিশ যা বলছে
জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি পরীক্ষায় জলিয়াতির অভিযোগে এখন পর্যন্ত আটক হয়েছেন মোট ২২ জন। তবে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত চক্রটিকে এখনও শনাক্ত করা যায়নি। আর আটকরা কেউ ছাত্রলীগ নেতার নাম জানায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার পরদর্শক (তদন্ত) আতাউর রহমান খোন্দকার বলেন, ‘এ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ২২ জন আসামী আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে তোফায়েল আহম্মেদ নামে এক জন রিমান্ডে রয়েছেন। তিন জনের আদালতে রিমান্ড আবেদন চাওয়া হলে শুনানি না হওয়ায় তাদের আশুলিয়া থানা পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। বাকি ১৮ জনেক কয়েকজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত কারাদ- দিয়েছেন, বাকিদের বিরুদ্ধে মামলার পর তাদেরকে চালান দেয়া হয়েছে। সূত্র : ঢাকাটাইমস
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন