জেলেপাড়ায় চাপা কান্না: যাঁরা ফিরে এসেছেন, আর যাঁরা ফেরেননি
মহেশখালীর চরপাড়া জেলেপল্লিতে সুনসান নীরবতা। শিশুদের হইচই চিৎকার নেই। জেলে বউদের হাসির শব্দ শোনা যায় না। মাঝেমধ্যে শুধু দু-একটা পাখির ডাক। হঠাৎ নীরবতা ছাপিয়ে কানে আসে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের শব্দ। এ গাঁয়ের নয়জন জেলে এখনো নিখোঁজ। স্রষ্টার কাছে দয়া ভিক্ষা চাওয়া ছাড়া ওদের এখন আর কিছুই করার নেই।
কক্সবাজারের মহেশখালীর জেলেরা ২৮ মে মাছ ধরা ট্রলারে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন। দুদিন পরই আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। সরকারি হিসেবে শুধু এ অঞ্চলের ৫২ জন জেলে এখনো বাড়ি ফেরেননি। তাঁরা বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন কেউ জানেন না।
কেউ কেউ সাগরে ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ফিরেছেন। তাঁদের কাছে ছুটছেন নিখোঁজ জেলেদের স্বজনেরা। শেষ মুহূর্তে তাঁরা কেমন ছিলেন, সেটুকু শুনবেন বলে।
৫ জুন মহেশখালীর চরপাড়া জেলেপল্লিতে ঘুরে কথা হয় বেশ কিছু জেলে পরিবারের সঙ্গে।
সেনোয়ারা বেগমের স্বামী মমতাজ উঠেছিলেন শুক্কুর আলী বহদ্দারের ট্রলারে। সাগরের মতিগতি ভালো লাগেনি সেনোয়ারার। স্বামীকে নিষেধ করেছিলেন। মমতাজ বলেছিলেন, এই মৌসুমে সেটিই শেষ ‘ট্রিপ’। এরপর দুই মাস আর ঘর থেকে বের হবেন না। সেনোয়ারার গলায় যে খুব জোর ছিল তা-ও নয়। চার-চারটি সন্তান। ঘরে না ছিল কাঁচা মাছ, না শুকনো। বাড়ি ছাড়ার আগে বহদ্দারের (ট্রলারের মালিক) কাছ থেকে ৫০০ টাকা চেয়ে স্ত্রীর হাতে গুঁজে দিয়ে চলে যান। সাত দিন পরই ফিরবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
মমতাজ ট্রলারে ওঠার দুদিন পরই এলাকায় মাইকে জানানো হয়, ঝড় আসছে। এক দিনের মধ্যেই সতর্কসংকেত ২ থেকে ৭, তারপর ১০ নম্বরে ওঠে। সাগরপারের মানুষ সাগরের ভাষা বোঝেন। তিনি বলছিলেন, ‘দইজ্জা দেখিয়ানে আঁর মনের মাঝে জানাইর স্বামী নাই।’ সেনোয়ারা স্বামী যে ট্রলারে ছিলেন, সে ট্রলারের চারজন জেলে ফিরে এসেছেন। তিনি জানতে পেরেছেন, বাঁশ ধরে মমতাজ ১১ ঘণ্টা বেঁচেছিলেন। তারপর সাগরে তলিয়ে গেছেন। সেনোয়ারা কাঁদছিলেন। গ্রামের লোক চাঁদা তুলে স্বামীর জন্য মিলাদ করেছে ৪ জুন। এক দিন পর ছেলেমেয়েরা সেই উচ্ছিষ্ট খেয়েছে। বলছিলেন, ‘গুড়াগাড়া ফোয়াছাও, ক্যাঙ্গরি বাইচ্যুম!’ কথা শেষ না হতেই মমতাজের সবচেয়ে আদরের মেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পরমিনা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল ঘূর্ণিঝড়ের দিন দশেক আগে। মা-বাবার বড় মেয়ে। দিনমজুর বাবা শখ করে মেয়েকে দুই কামরার মাটির ঘর তুলে দিয়েছিলেন। যতটা ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া সম্ভব, ততটাই ধুমধাম হয়েছিল বিয়েতে। জিয়াউর রহমান স্ত্রীকে দুই হাজার টাকা দিয়ে পাথর বসানো বিয়ের শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন, এক ডজন সিটি গোল্ডের চুড়ি, একটা ঘড়ি আর নাকফুল। গৃহ প্রবেশ উপলক্ষে জিয়াউর নিজেই দরজায় ফুল-লতা-পাতা এঁকে নকশাও করেছিলেন। সেই স্ত্রী আর ঘর ফেলে সাগরে যান। পরমিনা দরজায় দাঁড়িয়ে স্বামী ফেরার অপেক্ষা করেন।
পরমিনার সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার আগেই তাঁর বাড়ির দাওয়ায় গ্রামের আরও তিনজন জেলে বউ এসে দাঁড়ান। সবারই ছোট ছোট সন্তান। একজনের কোলে একটি, আরেকটির জন্ম হবে খুব শিগগিরই। তাঁরা বলছিলেন, বহদ্দাররা লোভে পড়ে সাগরে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের স্বামীদের। এখন আর চিনতে চাইছেন না।
মহেশখালী ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক গতকাল বলেন, তাঁরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত। সাগরে ট্রলার ডুবির কারণে ক্ষতিতে পড়েছেন। সরকারের কাছে তিনি জেলে পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের দাবি জানান।
সাগরে ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে চরপাড়ার যে চার জেলে ফিরে এসেছেন, মোহাম্মদ নূর তাঁদের একজন। তিন দিন সাগরে ভেসেছিলেন। পরে ভারতীয় নৌবাহিনী তাঁদের উদ্ধার করে। মোহাম্মদ নূর বলছিলেন, তাঁরা যাচ্ছিলেন সুন্দরবনের দিকে। হঠাৎ একটি ট্রলার ঘূর্ণিঝড়ের খবর জানায়। কিন্তু তাঁরা কূলে ভেড়ার আগেই নৌকার পাটাতন ভেঙে যায়। জালের সঙ্গে জারিকেন ধরে তাঁরা ভাসতে থাকেন। একপর্যায়ে শরীর অসাড় হয়ে আসে। মাছ আর জলজ প্রাণীরা ঠোকরাতে শুরু করে। পাশেই ভেসে থাকা শাহাবুদ্দীন জেলে আর পারছিলেন না। বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে মোহাম্মদ নূরের বুকের মাঝখানটা কামড়ে ধরেন। এর একটু পরই মৃত্যু হয় শাহাবুদ্দীনের।
ঝড়ের খবর জানতে পারেননি কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ নূর বলেন, কূলের কাছে রেডিও শুনতে পেলেও একটু ভেতরে গেলেই তাঁরা একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তাই সাগরের মেজাজ-মর্জি অনুমান করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাঁদের।
জানা যায়, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ৪ জুন তথ্যসচিব বরাবর কক্সবাজারে বাংলাদেশ বেতারের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, ‘জেলেদের দুর্যোগের সময় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো বাংলাদেশ বেতার। কিন্তু কক্সবাজারের কেন্দ্রের এখন ফ্রিকোয়েন্সি মাত্র ১০ স্কয়ার কিলোমিটার। জেলেদের টেকনাফের দক্ষিণে ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরে, কুতুবদিয়া মহেশখালী—এ দুটি উপকূলবর্তী উপজেলার পশ্চিমে প্রায় ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে এমনকি অনেক সময় ১০০ কিলোমিটার দূরে মাছ ধরতে যেতে হয়। দুর্যোগকালে স্থলভাগে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হলেও সমুদ্রে এই ভয়াবহতার হার অপ্রতুল যোগাযোগমাধ্যমের কারণে কমানো যাচ্ছে না।’
মহেশখালীতে এখন উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নিখোঁজ ও মৃত জেলেদের নামের তালিকা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ। এই তালিকা ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সোমবার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তিন হাজার করে টাকা পাবে।
কিন্তু তারপর কী হবে? মো. নূর চান না তাঁর তিন ছেলে আর সাগরে যাক। সেনোয়ারাও চান না। তবু সাগরই যেন তাঁদের নিয়তি। সেনোয়ারা বেগমের দুই ছেলের হাতে এখন সংসারের হাল। কূলের কাছে মাছ ধরে হাত পাকাচ্ছিল। হয়তো আর কয়েক বছর পরই ওরাও জীবন বাঁচাতে সাগরে ছুটতে বাধ্য হবে।-প্রথম আলো।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন