প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন উড়িয়ে দেয়ার টার্গেট ছিল পাইলট সাব্বিরের
উড়োজাহাজ চালিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন উড়িয়ে দেয়ার টার্গেট ছিল বিমানের কো-পাইলট সাব্বির এনামের। একই সঙ্গে যাত্রীসহ একটি ফ্লাইট সিরিয়ার আইএস ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়ার টার্গেট ছিল তার।
বুধবার সাব্বিরসহ গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ড আবেদনের প্রতিবেদনে র্যাব এ দাবি করেছে। শুনানি শেষে কো-পাইলট (ফাস্ট অফিসার) সাব্বির এনামসহ ছয় আসামির বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ছয় আসামিকে আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
শুনানি শেষে বিচারক আসামি সাব্বির এনামের ৭ দিনের ও তার মা আসামি সুলতানা পারভীনের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এছাড়া অপর চার আসামি মো. আলম, মো. আসিকুর রহমান আসিফ, মাজাহার হোসেন ও সম্রাট হোসেনের ৬ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। র্যাব আসামিদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর শাহ আলম তালুকদার, আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী পুলিশ সুপার মিরাশ উদ্দিন রিমান্ড শুনানি করেন। অপরদিকে আসামিপক্ষে আইনজীবী না থাকায় বিচারক কিছু বলার আছে কিনা জানতে চাইলে আসামি সাব্বির ও তার মা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, হলি আর্টিজানে হামলার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জঙ্গি সন্দেহে পাইলট কেবিন ক্রু ও বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ৬০ জনের একটি তালিকা তৈরি করলেও রহস্যজনক কারণে তা আমলে নেয়নি বিমান ম্যানেজমেন্ট। আমলে নেয়া তো দূরের কথা তালিকাটি সে সময় গায়েব করে দেয়া হয়েছিল। ওই তালিকায় কো-পাইলট সাব্বির এনামের নামও ছিল। যার খেসারত হিসেবে এখন বড় ধরনের ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে বিমান। কো-পাইলট সাব্বির এনাম গ্রেফতার হওয়ার পর এখন ওই তালিকা নিয়ে তোলপাড় চলছে। বিমানের পরিচালনা পর্যদ তড়িঘড়ি করে জরুরি বৈঠক ডেকেছে আগামী মঙ্গলবার। সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে কো-পাইলট সাব্বির এনামকে। গঠন করা হয়েছে একটি তদন্ত কমিটি। কমিটিকে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা ম্যানেজমেন্টকে না জানিয়ে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত রয়েছেন, যাদের কর্মকাণ্ড সন্দেহজনক, যারা ফ্লাইটে না গিয়ে অকারণে একের পর এক সিক রিপোর্ট দিচ্ছেন তাদের একটি তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, এর আগে বিমানের কাস্টমার সার্ভিস বিভাগ এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আছে এরকম ৬০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। ওই তালিকার অধিকাংশই ছিল কেবিন ক্রু। কাস্টমার সার্ভিস বিভাগ সে সময় ৬০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একটি সুপারিশপত্রও তৈরি করেছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বিমান ম্যানেজমেন্টের একটি শীর্ষ গ্রুপ ও প্রভাবশালী মহলের তদবিরে সেই সুপারিশ আলোর মুখ দেখিনি। উল্টো সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মহলের রোষানলে পড়েন ওই বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আতিক সোবহান। তালিকাটি তিনি তৈরি করেছেন এমন ধারণা থেকে তাকে হেনস্তা করা শুরু হয় বলে জানা গেছে। বর্তমানে তার চাকরি হারানোর অবস্থা। ইতিমধ্যে ওই প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে আতিক সোবহানকে কাস্টমার সার্ভিস বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, সম্প্রতি বিমানের বিভিন্ন বিভাগে যাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে তার মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জনের বেশি আছেন যারা বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন
গুরুত্বপূর্ণ পদের নেতা হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়। অভিযোগ শুধু পদোন্নতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বিমানের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বিমানের দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত হলেও জঙ্গি তালিকা তৈরির অভিযোগে আতিক সোবহানকে কাস্টমার সার্ভিস বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক থেকে পদাবনত করে জেনারেল ম্যানেজার করে রাখা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সোনা চোরাচালানের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নকে দিয়ে তদন্ত করানো হয়। ওই তদন্তে আতিক সোবহানের বিরুদ্ধে আনা সোনা চোরাচালানের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। অথচ কাস্টমার সার্ভিস বিভাগ থেকে জঙ্গি সন্দেহে যে ৬০ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আর্মড পুলিশের তদন্তে সোনা চোরাচালান ও জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
অভিযোগ আছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠন করা তদন্ত কমিটির রিপোর্টকেও আমলে নেয়নি বিমান ম্যানেজমেন্ট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ জানান, পুরো বিমান ম্যানেজমেন্ট এখন বিএনপি-জামায়াতের নির্দেশে চলছে- যার কারণে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে নাট-বল্টু ঢিলা থাকার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল তাদের কারও বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়নি বিমান। ওই ঘটনায় বিমানের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিভাগ বিমান সিকিউরিটির শীর্ষ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ থাকলেও ম্যানেজমেন্ট তাকে উল্টো প্রমোশন দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এ ঘটনার পরও গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স ছাড়া তাকে পর পর দুই দফায় প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে সফরসঙ্গী করা হয়। এছাড়া বিমানের ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের একজন পাইলটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ থাকলেও ম্যানেজমেন্ট ওই কর্মকর্তাকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়।
সম্প্রতি বিমানের বিহঙ্গ ম্যাগাজিনে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও রিপোর্ট কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন জনসংযোগ বিভাগ। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তীব্র সামলোচনার ঝড় ওঠে। বিমান শ্রমিক লীগের সভাপতি মসিকুর রহমান এ ঘটনায় তার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ বিমানের ৮৪ পৃষ্ঠার ইনফ্লাইট ম্যাগাজিন বিহঙ্গ। ওই ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যায় খাবার দাবারের ছবি ৪ পাতাব্যাপী ছাপা হয়। অথচ বিএফসিসি বিভাগের খাবার-দাবারের কোনো রিপোর্ট নাই। রাশিফলের রিপোর্ট ছাপা হয় ২ পাতাব্যাপী। ভিয়েনা শহরের ছবি ৬ পাতাব্যাপী ছাপা হয় অথচ বিমানের ভিয়েনায় কোনো ফ্লাইট নাই। ৪-৫ পাতাজুড়ে ছাপা হয় বিভিন্ন বিজ্ঞাপন চিত্র। কিন্তু বাংলাদেশ বিমানের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ অবতরণের মতো বড় খবর ছাপা হয়েছে খুবই ছোট করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিজে ওই ফ্লাইটে উপস্থিত থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে ওই উড়োজাহাজ অবতরণ উদ্বোধন করেন। কিন্তু ব্যান্ডিংয়ের সে খবরটি দেয়া হয়েছিল নিদারুণ করুনা করে। স্থান দেয়া হয়েছিল বড়ই ঠাসাঠাসি করে।’
সিবিএ সভাপতির এ স্ট্যাটাসের পর পরই ফেসবুকজুড়ে হাজার হাজার কমেন্টস লিখেন বিভিন্ন মানুষ। এসব কমেন্টকে অনেকে বলেছেন, বিমান এখন বিএনপি-জামায়াতের দখলে। যারা বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতা ছিল তারাই পদোন্নতি পেয়ে বড় বড় আসন দখল করেছে। আর যারা সরকারের পক্ষের ও নিরপেক্ষ তাদের বিএনপি-জামায়াত বানিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছে। কমেন্টে এ ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের শাস্তি দেয়ার দাবি থাকলেও বিমান ম্যানেজমেন্ট কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বিমান হামলার পরিকল্পনাকারী পাইলট রিমান্ডে : বিমান ‘প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে’ নিয়ে ফেলবে বা বিমান যাত্রীসহ ‘সিরিয়ায় আইএস-এর ঘাঁটিতে’ নিয়ে যাওয়ার পকিল্পনা ছিল পাইলট সাব্বিরের। রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, দারুসসালাম থানার এ মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামি মো. বিল্লাল হোসেন (২৩) চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
জবানবন্দিতে আসামি বলে, ‘আবদুল্লাহ (জঙ্গি) যে বাসায় ভাড়া থাকত সেই বাসার মালিক আজাদ ও তার স্ত্রী সুলতানা পারভিন মাঝে মাঝে আবদুল্লাহর ফ্লোরে আসত এবং ছাদে উঠে চেয়ারে বসে কথা বলত। আবদুল্লাহও তাদের বাসায় যেত। আজাদ ও তার স্ত্রী একবার সংগঠনের জন্য ৩০ হাজার টাকা আবদুল্লাহকে দিয়েছিল। আজাদের মেয়ে øিগ্ধাও মাঝে মাঝে আবদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করত এবং আবদুল্লাহর সব বিষয় জানত। সুলতানা পারভিনের ভাইয়ের ছেলে আসিফ প্রায় সময় আবদুল্লাহর কাছে যেত এবং বথাবার্তা বলত। আসিফ ওই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। আজাদ ও তার স্ত্রী অস্ত্র কেনার জন্য আবদুল্লাহকে টাকা দিতে চেয়েছিল। এই আসিফ একবার একটি ৯এমএম পিস্তল তার বন্ধুর কাছ থেকে এনে বিক্রির জন্য দেখিয়েছিল। পিস্তলের মূল্য বলেছিল ৭০ হাজার টাকা। আজাদের একমাত্র ছেলে (সাব্বির এনাম) বিমানের পাইলট। গুলশান হামলার আগে বা পরে আবদুল্লাহ, সাব্বির, ফরহাদ (সাংগঠনিক নাম সরোয়ার জাহান) পরিকল্পনা করে যে, সাব্বির বিমান নিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে’ নিয়ে ফেলবে বা বিমান যাত্রীসহ ‘সিরিয়ায় আইএস-এর ঘাঁটিতে’ নিয়ে যাবে। সোমবার রাত দুইটা থেকে মঙ্গলবার বেলা ১১টা পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুরের দারুসসালামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে র্যাব সাব্বির এনামসহ চারজনকে গ্রেফতার করে। সূত্র : যুগান্তর
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন