ডাকসু নির্বাচনে সন্তুষ্ট কে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে ‘অসন্তুষ্ট’ হয়ে বিকেলের আগেই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রলীগ বাদে বাকি সবগুলো সংগঠনই। নির্বাচন বর্জন না করলেও ফলাফল প্রকাশের পর তা মানেন না বলে স্লোগান দিয়েছেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। এরই মধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদের ফলাফলও প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা।খবর সময়টিভি’র।
নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের তাড়া খেয়েছেন, স্বেচ্ছাসেবী পর্যবেক্ষকরা লজ্জিত হয়েছেন বলে জানিয়ে আবারও নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেছিলেন সুন্দর, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশেই ভোট হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত তিনিও ফলাফলস্থল থেকে হাসিমুখে ফিরতে পারেননি। এখন তার বাসার সামনে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন এই নির্বাচনে আসলে কে সন্তুষ্ট হয়েছেন?
দীর্ঘ ২৮ বছর পর সোমবার (১১ মার্চ) ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরুর পর থেকেই অনিয়মের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। বাংলাদেশ চীন মৈত্রী হলে সিল মারা বস্তাভর্তি ব্যালট পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। প্রশাসন এই অভিযোগে সত্যতাও পায়। এরপর এই হলের ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়। পরবর্তীতে হলের প্রাধ্যক্ষকে সরিয়ে বেলা ১১টা ১০ মিনিট থেকে শুরু হয় ভোটগ্রহণ। এছাড়া রোকেয়া হলেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়।
এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও প্রার্থীরা নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক এস এম মাহফুজুর রহমানকে তাড়া করেন। রোকেয়া হলের সামনে থেকে তাকে তাড়া করতে করতে একেবারে কলাভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলা পর্যন্ত নিয়ে যান তারা।
এসবের মধ্যেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সব সংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অনিয়মের অভিযোগের পাশাপাশি পুনর্নির্বাচনের দাবি জানান তারা। এর মধ্যে কয়েকটি সংগঠন মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটেরও ডাক দেয়।
অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ বাংলাদেশের যেকোনো নির্বাচনেই পরিচিত ঘটনা। তবে এই নির্বাচন নাকি লজ্জা দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী পর্যবেক্ষকদেরও। এতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে বলেও মনে করছেন তারা। তাইতো তারা বিবৃতি দিয়ে নতুন তফসিল ঘোষণা করে ভোটগ্রহণের দাবিও জানান। এছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীও এই নির্বাচন নিয়ে ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেন।
তাদের অভিযোগ যখন ভোটে কারচুরি ও অনিয়ম নিয়ে, তখন ছাত্রলীগের অভিযোগ যারা নির্বাচন বর্জন করেছেন তারা নাকি নাটক মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিলেন। বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী গোলাম রাব্বানী বলেন, যারা ডাকসু নির্বাচনের ভোট বর্জন করেছেন, তারা একটি সুন্দর নাটক মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন নেই বুঝেই তারা একটি ‘সেইফ এক্সিট’ খুঁজছিলেন।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মুখেও ছিল অনেকটা একই সুর। তার মতে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুন্দর, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন বলে দাবি করে তিনি তাদের ধন্যবাদও জানান।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে ২৫ হাজারের মতো ভোট পড়ে বলে গণনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এই ভোট গণনা করে ফলাফল ঘোষণা করতে লেগে যায় অনেকটা সময়। ২৮ বছরের বেশি সময় যেই নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা গেছে, তার ফলাফলের জন্য কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করা যাবে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে রাত জেগে যখন প্রার্থী, শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মীরা অপেক্ষা করছিলেন তখন ৩টা ২০ মিনিটে ফলাফল নিয়ে হাজির হন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান।
সর্বোচ্চ পদ দিয়েই ঘোষণা শুরু করেন তিনি। শুরুতেই জানান ডাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে নির্বাচিত হয়েছেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নুরুল হক নুরু। এরপর থেকেই হৈচৈ শুরু হয় সিনেট ভবনে। সেখানে উপস্থিত ছাত্রলীগ কর্মীরা স্লোগান দিতে শুরু করেন ভুয়া বলে। এসময় ফলাফল ঘোষণা কিছুটা ব্যাহত হয়। তবে এরপর যেই নামগুলো ঘোষণা করা হয় একটি পদ বাদে সবগুলোই ছিল ছাত্রলীগ প্যানেল থেকে যারা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের নাম। তবে স্লোগানের আওয়াজ বাড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে শিক্ষকদের মঞ্চের সামনে গিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন তারা।
পাশেই উপস্থিত ছিলেন গোলাম রাব্বানী। শিক্ষক ও ছাত্রলীগের এই নেতা কর্মীদের থামার জন্য বারবার আহ্বান জানালেও থামেননি তারা। প্রায় ২৫ মিনিট পর পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়। তখন রাব্বানী বলেন, স্যার (উপাচার্য) কিছু বলতে চান। কিন্তু পাশেই দাঁড়ানো আরেক শিক্ষক বলেন, স্যারের কিছু বলার দরকার নেই। অনেকটা ‘অসন্তুষ্টি’ নিয়েই মঞ্চ ত্যাগ করতে হয় তাদের। এর কিছুক্ষণ পরই ভিপি পদের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হিসেবে জয় পাওয়া গোলাম রাব্বানী।
দিনব্যাপী নির্বাচন বর্জনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানালেও এবার তার বাসার সামনে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। এই পদে আবারও নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন তারা। নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পর যিনি বলেছিলেন, ‘আমি খুব আনন্দিত অনুভব করছি’, ফলাফল ঘোষণার পর ছাত্রলীগের এমন প্রতিবাদ তাকে যে কিছুটা অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
যেই নির্বাচন নিয়ে অংশগ্রহণকারী সকল সংগঠনই প্রতিবাদ জানিয়েছে, যেই নির্বাচন শিক্ষকদের ‘অস্বস্তিতে’ ফেলেছে, যেই নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের লজ্জা দিয়েছে, সেই নির্বাচনে আসলে কে সন্তুষ্ট হলেন? এই প্রশ্ন এখন অনেকেরই।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন