ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলার হিড়িক
সদ্য পাস হওয়া ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়েরের হিড়িক পড়েছে। গত দুই দিনে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালেই ১৩টি মামলার দরখাস্ত দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে ৫টির তদন্ত ও দুটি সংশ্লিষ্ট থানাকে এফআইআর গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বাকি ছয়টি খারিজ করে দিয়েছেন বিচারক। মাত্র দু’দিনের মামলার পরিমাণ দেখে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের চেয়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বেশি মামলা বেশি হতে পারে। এর ফলে নতুন আইনে মামলার সংখ্যা বাড়তে। এই আইনে এমন কিছু ধারা রয়েছে, যে কেউ ইচ্ছা করলেই মামলা করতে পারবেন। এসব ধারা ব্যাপকহারে অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কাও করছেন তারা।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার সাইবার ট্রাইবুন্যালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘সোমবার আদালতে সাতটি মামলার পিটিশন দায়ের হয়েছিল। আজও ছয়টি পিটিশন দাখিল হয়েছে। মনে হচ্ছে, নতুন আইনে মামলার সংখ্যা বাড়বে।’
নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘আগের আইনে কোনও একটি বিষয় প্রচার করলেই কেবল মামলা করা যেতো। এখন শুধু প্রচার নয়, কেউ যদি কিছু দেখিয়ে প্রচার করার হুমকিও দেয়, তাহলেও মামলা করা যাবে। ফলে মামলার সংখ্যা যে বাড়বে, তা সহজেই অনুমেয়।’
ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দায়ের করা ছয়টি মামলার মধ্যে চারটি তদন্তের নির্দেশন দিয়েছেন আদালত। আর দুটি মামলা খারিজের আদেশ দিয়েছেন। এসব মামলার মধ্যে একটি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে দায়ের করা হয়। সেটি সরাসরি এফআইআর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) হিসেবে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি বৌদ্ধধর্মালম্বীদের প্যাগোডা ধ্বংস করা এবং সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে এবং একজনের মেয়েকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে দায়ের করা হয়েছে।
এরআগে সোমবার সাতটি মামলার জন্য পিটিশন দাখিল হয়েছিল। এরমধ্যে একটি মামলাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুটি মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে গেন্ডারিয়া ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলো খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, সোমবার দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে একটিতে একজন নারীর তার সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ভাইবার ও ইমোতে আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করার অভিযোগ এনেছেন। আরেকটি মামলায় একজন নারী তার ছবি বিকৃত করে প্রকাশ করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। এক ব্যক্তি ফেসবুকে তার নামে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র জানায়, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে প্রথম মামলা হয়েছে রাজধানীর পল্টন থানায়। গত ১০ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মেডিক্যালের ভুয়া প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে। এছাড়া গত একসপ্তাহে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে আরও বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের হয়েছে। তবে ডিএমপির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মামলার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানাতে পারেননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা নিয়ে আতঙ্ক ছিল। সমালোচনার মুখে সেই ধারা বাতিল করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু নতুন আইনে ৫৭ ধারার সব উপাদান ঢুকিয়ে আরও এমন কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যাতে অনেকের মধ্যেই মামলা দায়েরের প্রবণতা বাড়বে। এর মধ্যে জামিন অযোগ্য ধারাগুলো হলো—১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৪ ধারা।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখান, তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। ২৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়াই অন্য কোনও ব্যক্তির পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এসব ঘটনায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাত বছরের দণ্ড এবং দশ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহলে তার ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা হবে৷ ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ মানহানিকর কোনও তথ্য দিলে সেই ব্যক্তির তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে৷ ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির সেসব কাজ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনও সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনও সংস্থার কোনও অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির ওই কাজ কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের অনেকগুলো ধারাকে সংবাদমাধ্যমগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অন্তরায় হিসেবেও দেখছেন। এই আইনের সুনির্দিষ্ট ৯টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে সংবাদকর্মীরা। এই দাবিতে প্রথমবারের মতো দেশের শীর্ষ স্থানীয় গণমাধ্যমের সম্পাদকরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনও করেছেন।
সংবাদকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীরা অনেকেই বলছেন, এখন তারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ যে কেউ চাইলেই সরকারি দফতরে অনুপ্রবেশ ও গোপনে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণের পর সম্প্রচার করলে মামলা করতে পারে। যদিও নতুন আইনে এখন কোনও সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘প্রায় আট-নয়টি ধারা রয়েছে, যেগুলোয় শুধু সংবাদকর্মীরাই নয়, মানবাধিকারকর্মী ও গবেষকদের জন্যই বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর গত দুই দিনে যে হারে মামলা হয়েছে, তা দেখে স্পষ্টতই বোঝা যায়, এই আইনের অপব্যবহার হবে। সংবাদকর্মী বা মানবাধিকারকর্মীরা স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হবেন। এমনকি প্রকারান্তরে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও খর্ব হবে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন