ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে
বিগত বছরগুলোর মধ্যে ২০০২ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো সর্বোচ্চ সংখ্যক ৬ হাজার ২৩২ জন। অপরদিকে, চলতি বছরের শুরু থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৪৭৯ জনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু মৌসুম শেষ হতে এখনও প্রায় তিন মাস বাকি। সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ডেঙ্গু প্রকোপ অঞ্চলে বাংলাদেশসহ ভারত, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যাণ্ড, পূর্ব তিমুর ও উত্তর কোরিয়া রয়েছে। সংস্থাটি বলছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মানুষ এই অঞ্চলে বসবাস করে। দ্রæত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অঞ্চলে এই দুটি রোগ ছাড়াও কীটবাহিত অন্যান্য রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে কোনো মৃত্যু না হলেও বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৫৬ জন। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৩৫ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৪৫ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩১ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১৬ জন, বারডেম হাসপাতালে চার জন, পিলখানার বিজিবি হাসপাতাল ৮ জনসহ ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ২৭৬ জন ভর্তি রয়েছেন।
অপরদিকে, এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে সরকারি হাসপাতাল থেকে ঘরে ফিরেছেন ছয় হাজার ১৮৭ জন। অপরদিকে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। তবে একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, এবারে ডেঙ্গুর প্রকোপে মৃত্যুর ঘটনা আরও ঘটেছে। সব মৃত্যুর খবর স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমে রিরোর্ট হয়নি। হাসপাতালগুলো থেকেও সেসব সংবাদ আসেনি। প্রকৃত তথ্য পেলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেড়ে যেত।
চলতি বছরের গত ৯ জুন প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ৩৪ বছরের ফারজানা আক্তার নামের ওই রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন ৭ জুন। সে মাসেই ৩১ বছরের রোজলিন বৈদ্য এবং ২৬ বছরের সেঁজুতি নামে আরও দুজন মারা যান।
পরের মাসে এক বছর সাত মাসের আরইয়ান, আট বছরের হিমু, নয় বছরের তাহমিদ এবং বারডেম হাসপাতালে কর্তব্যরত ২৭ বছরের ডা. ফয়সাল বিল্লাহ মারা যান। এর পরের মাস আগস্টে ৫৫ বছরের মৃদুলা বেগম, দুই বছরের শ্রেষ্ঠা ঘোষ, পাঁচ বছরের আমিনা, ১২ বছরের তাহজীব খান, ৪৯ বছরের মাকসুদা বেগম, পাঁচ বছরের আরাফাত ইসলাম মারা যায়। চলতি মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে মারা যায় ৪০ বছরের আর্জিনা বেগম, দুই বছরের সাফায়াত এবং তিন বছর বয়সী সুমাইয়া। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট মারা যায় ১৬ জন-তবে এর মধ্যে নারী এবং শিশুর সংখ্যাই বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায় ২০০০ সালে। সে বছরে রেকর্ড সংখ্যক ৯৩ জন রোগী মারা যান। মোট রোগী ছিলেন ৫ হাজার ৫৫১ জন। ২০০১ সালে দুই হাজার ৪৩০ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ৪৪ জন রোগী, ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ১০ জন, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৪৩৪ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ১৩ জন, ২০০৫ সালে ১ হাজার ৪৮ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ৪ জন, ২০০৬ সালে মারা যান ১১ জন, রোগী ছিলেন দুই হাজার ২শ জন, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কেউ মারা না গেলেও রোগী সংখ্যা ছিলেন যথাক্রমে ৪৬৬ জন, এক হাজার ১৫৩ জন, ৪৭৪ জন এবং ৪০৯ জন। তবে তার পরের বছর থেকেই আবারও রোগীর মৃত্যু শুরু হয়।
২০১১ সালে মারা যান ৬ জন, রোগী ছিলেন এক হাজার ৩৫৯ জন, ২০১২ সালে মারা যান একজন, রোগী ছিলেন ৬৭১ জন। ২০১৩ সালে মারা যান ২ জন, রোগী ছিলেন এক হাজার ৭৪৯ জন। আবার ২০১৪ সালে কেউ মারা না গেলেও রোগী ছিলেন ৩৭৫ জন। ২০১৫ সালে মারা যান ৬ জন, রোগী ছিলেন ৩ হাজার ১৬২ জন। ২০১৬ সালে মারা যান ১৪ জন, রোগী ছিলেন ছয় হাজার ৬০ জন এবং গত বছরে মারা যান ৮ জন এবং রোগী সংখ্যা ছিলেন দুই হাজার ৭৬৯ জন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, চলতি বছরে ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে একইসঙ্গে ডেঙ্গুর জীবাণু বাহিত এডিস মশা প্রজনন হয়েছে বেশি। বছরের মাঝামাঝিতে বৃষ্টি হয়েছে আর বৃষ্টি হলেই যে কোনো পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এক ডিম থেকে লার্ভা হয় হাজার হাজার এবং সেখান থেকে এডিস মশার জন্ম হয়।
বিক্ষিপ্তভাবে যেখানে পানি জমা হয়েছে সেখানেই এডিস মশার জন্ম হয়েছে। কিন্তু পানি যদি ভেসে যাবার মতো পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এতো মশার জন্ম হতো না। আবার এসব মশা ঘরে ঢোকে। ফুলের টবে, ছাদের বাগানের পানিতেও এ মশা জন্মায়।
ঘরে-বাইরে সব জায়গায় এডিস মশার প্রজনন বেড়েছে। এমন কী-বিভিন্ন সড়কের আইল্যান্ডেও পানি জমে থাকে, সেখানেও মশার জন্ম হচ্ছে। ফলে এডিশ মশার বংশ বিস্তার বেশি হওয়াতে এবারে ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপক হারে হয়েছে বলেন অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ। শীতের আগ পর্যন্ত এভাবে যদি চলতেই থাকে তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে না বলেও আশঙ্কা করেন তিনি। তিনি বলেন, শীত মৌসুমে গিয়ে যদি ডেঙ্গু কিছুটা কমে আসে।
অপরদিকে, জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম উল্লেখ করে ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, থেমে থেমে হতে থাকা বৃষ্টিটা না কমলে ডেঙ্গুও কমবে না। ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম থাকলেও শীত শুরু হয়ে গেলে কমতে থাকবে এর প্রকোপ। তবে এ জন্য সবাইকে সচেতন এবং সাবধান হবার পরামর্শ দেন তিনি।
ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ঝুঁকি বেড়েছে, এর প্রমাণ চলতি বছরগুলোতে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এ প্রকোপ আরো বেড়ে গিয়েছে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন