ঢালাওভাবে মামলায় বিপ্লব সুসংহত হবে না : ফখরুল
অন্তর্বর্তী সরকার, জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলো কে কী চায়, তা জানার জন্য অতি দ্রুত বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, এ বিষয়টা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। না হলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। এ ছাড়া ঢালাওভাবে মামলা দিলে বিপ্লব সুসংহত হবে না। মামলা করার আগে যাচাই করতে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে বিদেশ থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
এক এগারোর মতোই বিএনপিকে লক্ষ্য করে অপপ্রচার করা হচ্ছে বলেও জানিয়ে এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বানও জানান তিনি। গতকাল দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই আহ্বান জানান।
এদিকে বন্যার কারণে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে জানিয়ে মহাসচিব বলেছেন, দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে যে অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা ছিল- সেটি ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি সম্পর্কে মহাসচিব বলেন, ১ সেপ্টেম্বর শুধুমাত্র দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। দলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনে গত ২১ আগস্ট পাঁচ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও উপস্থিত ছিলেন। মির্জা ফখরুল বলেন, কোনো ধরনের দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী জড়িত নয়। যদি দুই-একজন করে থাকে, তবে সেটি বিএনপি নয়। সেটা তারা ব্যক্তিগতভাবে করেছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ঢালাওভাবে মামলা না করার পরামর্শ দিয়ে নেতা-কর্মীদের বিএনপির মহাসচিব বলেন, পুলিশের সঠিক তদন্তের মাধ্যমে যাচাই করে নিন। এমন কোনো মামলা দেবেন না, যে মামলায় দোষী সাব্যস্ত হবে না। সব মামলা কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে না করে, যেখানে যারা সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের নামে মামলা করতে হবে। অনেক জায়গায় জেলা প্রশাসকের নামেও মামলা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আবার নেওয়া হচ্ছে। আমরা চাই বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা করে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে। যেভাবে মামলা হচ্ছে, তা এ বিপ্লবকে সংহত করবে না। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে। অবশ্যই আমরা তাদের যৌক্তিক সময় দেব। সকল প্রকার সহযোগিতা আমরা এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আমরা কিন্তু ভুলে যাইনি ওয়ান ইলেভেনে কারা কারা বিরাজনীতিকরণে ভূমিকা পালন করেছিল। রাজনীতির দরকার নেই, তারা একটি সিলেক্টেড গভর্নমেন্টের কথা বলেছিল।
সে সময় বিএনপিকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ও বাতিল করার পাঁয়তারা করেছিল। এ কথাগুলো আমরা ভুলতে পারি না। দেশের জন্য, মানুষের জন্য, রাজনীতির জন্য, এ কথাগুলো তো মনে রাখতেই হবে। যখন আমরা তাদের আবার সামনে দেখি, তখন সন্দেহ হয়, প্রশ্ন এসে যায়। এ জন্য আমরা বারবার বলে যাচ্ছি, এবারের আন্দোলনে যারা বাধা দিয়েছে এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের চেহারাগুলো দেখতে চাই না। একই সঙ্গে যারা গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার জন্য কাজ করেছে, সেই চেহারাগুলোও আমরা দেখতে চাই না। বিএনপি মহাসচিব বলেন, গণবিপ্লবকে নস্যাৎ করতে বা ব্যর্থ করতে অনেক ধরনের চক্রান্ত চলছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে এখনো অনেক ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য হলো- বাংলাদেশের বিপ্লবকে নস্যাৎ করে দেওয়া। যেখানে বলা হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে, যার এক পারসেন্টও সঠিক না। মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, বিএনপি গত ১৫ বছর ধরে এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেশি ত্যাগ করেছে। সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সাড়ে ছয় বছর জেল খেটেছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাসিত হয়েছেন। বিএনপির এমন কোনো নেতা-কর্মী নেই যারা অন্যায় নিপীড়নের শিকার হয়নি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণ মনে করে না যে, তারা সরকার চালাতে পারবে। তারা ভিন্ন মতে জনগণের চিন্তাভাবনা করে। আমি সেই রাজনৈতিক দলের নাম বলছি না। আমরা লড়াইটা করেছি গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য। সেটার জন্য তো আমরা নির্বাচনের কথা বলব। এটা তো আমাদের রাইট (অধিকার) আছে। আমরা নির্বাচনের জন্যই এত দিন ধরে সংগ্রাম-লড়াই করে আসছি। যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলো, তখন সেটি ফিরিয়ে আনার জন্য ওই দলগুলো মিলেই আন্দোলন করেছি। এ আন্দোলনের পর ওই দলগুলোকে কিন্তু অনেক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি তাদের অফিস পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ওই বিষয়টিকে বাদ দিয়ে তো কোনো রাজনৈতিক চিন্তা করব না।
‘জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন বাতিলের বিষয়টি কীভাবে দেখছেন’ এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই, যে কোনো দল যে কোনো ব্যক্তি তার স্বাধীন দল করার অধিকার আছে। এটিই গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। কিন্তু স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের পক্ষে থাকতে হবে। স্বাধীনতাকে যারা বিশ্বাস করে না তাদের সমর্থন করা যাবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে কোনো বিরাজনীতিকরণের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন কি না?- এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে এখনো এমন কোনো লক্ষণ দেখছি না। তবে আমি সতর্ক করছি। কিছু ফেস দেখছি, যাদের আমরা কোনোদিন দেখিনি, হঠাৎ করেই তারা মিডিয়াতে ফ্রন্ট পেজে চলে আসছে। তাদের বক্তব্য, তাদের থিউরি- এগুলো আপনারা প্রচার করছেন। আমার কাছে মনে হয়, এটি সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভালো বিষয় নয়। আমি নাম বলতে চাই না, যাদের কোনোদিনই দেখলাম না, তারা হঠাৎ করেই ফ্রন্ট পেজে চলে আসছে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের তো আমরা চিনি না, তাদের বক্তব্য কী, তারা কী করতে চান? সেটাও বুঝি না। দেশের মানুষও বোঝে না।
আমরা তো এক-এগারোর কথা ভুলে যাইনি : অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত নির্বাচন দাবি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা এখনো এক-এগারোর কথা ভুলে যাইনি। তাই আবার যখন ওই ভয়ংকর চেহারাগুলো সামনে আসে, তখন যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়, প্রশ্ন সামনে এসে যায়।
৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু নির্যাতন ও দখল নিয়ে বিএনপিকে লক্ষ্যবস্তু করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ কাজগুলো করা হচ্ছে- আবার এক-এগারোর মতো বিএনপিকে লক্ষ্য করে, বিরাজনীতিকীকরণের চেষ্টা থেকে।
জামায়াতে ইসলামীকে ইঙ্গিত করে মির্জা ফখরুল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে বাতিল করা হলো, তার জন্য ওই দলগুলো মিলেই তো আমরা আন্দোলন করেছি। ওই দলগুলোর অনেকের আন্দোলনে অনেক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এমনকি তাদের অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ওই আন্দোলনকে ওই বিষয়কে বাদ দিয়ে আমি তো অন্য রাজনৈতিক চিন্তা এই মুহূর্তে করব না।
তিনি বলেন, হ্যাঁ, অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে একটি আন্দোলন-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। অবশ্যই এই সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে হবে। তার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা আমরা করে যাচ্ছি, করব যত দিন আমরা মনে করি সরকার রাইট ট্রাকে থাকবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে যারা কাজ করেছেন, যারা সহায়তা করেছেন, তাদের যেভাবে দেখতে চান না, সেই একইভাবে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার জন্য, ধ্বংস করার জন্য যারা কাজ করেছেন তাদেরও এ দেশের মানুষে দেখতে চায় না। মানুষ এখানে একটা ডেমোক্র্যাটিক সেটআপ চায়, গণতন্ত্র চায়। মানুষ নির্বাচন চায়। এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
তিনি বলেন, এখন আমি যদি মনে করি, একজন ব্যক্তি দেশকে একেবারে স্বর্গ বানিয়ে দিতে পারবে- ওই চিন্তাটা সঠিক হবে না। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে দেশ কীভাবে চলবে। সংস্কারের দাবি তো আমরাই তুলেছি। আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। ৩১ দফা থেকে কমিয়ে ১০ দফা হয়েছে, ১০ দফা থেকে এক দফা হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছি সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছি। আমরা তো সংস্কার চাই। তবে সেই সংস্কারটা অবশ্যই হতে হবে জনগণের সমর্থন নিয়ে। জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়, এমন বক্তব্য না দিতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান বিএনপির মহাসচিব।
বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, প্রথম দিকে তারা যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রচার চালিয়েছিল, এর বোধ হয় এক দুই পারসেন্টও সঠিক নয়। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, দখলদারি। এগুলো কিন্তু একটা ক্যাম্পেইন। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আবার আগের মতো এক-এগারোর মতো বিএনপিকে লক্ষ্য করে এ কাজগুলো করা হচ্ছে। এটা অত্যন্ত অন্যায়। আমরা ১৫ বছর ধরে সংগ্রাম করেছি গণতন্ত্রের জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রে নির্বাচিত সংসদ ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান হয় না।
দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে লুটপাটের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশেই লুটপাট হচ্ছে বলে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও অভিযোগ করেন। অভিযোগের এ বিষয়টি নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, কোনো লুটপাটে বিএনপির নেতা-কর্মীরা জড়িত নয়। এমন কাজে কেউ জড়িত থাকলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে বিদেশ থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন