দুর্ঘটনা এড়াতে শুধু ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণই সমাধান?
গত বছরের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং এসপ্তাহে নদ্দা এলাকায় বিইউপি’র ছাত্র আবরার আহমেদের মৃত্যুর পর সড়ক পরিবহন পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোনো সংস্কার না হলেও একটি উদ্যোগ খুব দ্রুতবেগে নেয়া হয়েছে – ফুট ওভারব্রিজ তৈরি।
ঢাকার ব্যস্ততম একটি সড়ক মিরপুর রোড। সেখানকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, যেখান থেকে একদিকে মিরপুরমুখী রাস্তা, বিপরীত দিকে নিউমার্কেট মুখী সড়ক। আরেকদিকে ধানমন্ডিগামী সড়ক এবং তার উল্টো দিকে এলিফেন্ট রোড।
বুধবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে মোড়টিকে ব্যস্ত সড়কগুলো সিগন্যালে থামার সাথে সাথেই রাস্তা পেরিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের দিক থেকে অপর পাশে যেতে উদ্যত হলেন পঞ্চাশোর্ধ একজন ব্যক্তি।
কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলেন দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা। বললেন, উপরের “ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে যান।”
তবে প্রবীণ ব্যক্তিটি তারপরও বলার চেষ্টা করলেন ,”অন্য সময় তো নিচ দিয়েই পার হই।”
কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ মানতে রাজি নন।
অগত্যা কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফুট ওভারব্রিজের দিকে হাটতে শুরু করলেন ওই প্রবীণ ব্যক্তি। তার মত আরও অনেককেই দেখা গেল ফুট-ওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও তার নিচ দিয়েই রাস্তা পেরোতে আগ্রহী।
আরেকজন বয়স্ক মহিলা বললেন, “দ্যাখেন ফুট ওভারব্রিজ পার হইতে অনেকগুলা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা লাগে, আমার হাঁটুতে ব্যথা। একবার উপরে ওঠো, আরেকবার নামো-আমি তো বাবা পারিনা।”
আরেকজন পাশ থেকে বলে ওঠেন, “আর ওখানে উঠে দ্যাখেন, ভিক্ষুক শুয়ে আছে, মনে হয় পা টেনে ধরবে, ফেরিওয়ালা বসে আছে। বৃষ্টির মধ্যে মনে হয় পা পিছলে পড়ে যাবো।”
কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন অংশে পথচারীদের রাস্তা পারাপারের সুবিধার কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে এসব ফুটওভার ব্রিজ।
ঢাকার নদ্দায় প্রগতি সরণিতে বাসের চাপায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র প্রাণ হারানোর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলে, দুর্ঘটনাস্থলে নিহত শিক্ষার্থীর নামে নতুন একটি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র।
কিন্তু যেখানে ব্যস্ত সড়কগুলোতে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে আগ্রহ নেই পথচারীদের, সেখানে নতুন করে ওভারব্রিজ নির্মাণ করলে কী লাভ হবে?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটের শিক্ষক এবং অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক প্রধান অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “যত গতি তত ক্ষতি। মোড়ে মোড়ে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে তো লাভ নেই।”
“আমাদের এখানে বাসের চাপায় মানুষ মারা যাচ্ছে- দুই বাসের মধ্যে পিষে মেরে ফেলছে।”
“ফুট ওভারব্রিজ যেখানে সিগন্যাল নাই দুইটি মোড়ের মাঝে ইফেক্টিভ হবে। মোড়ে হলে ইফেক্টিভ হবে না।”
তিনি মনে করেন, এটা একটা পুরনো আমলের ধারণা। রাস্তা পারাপারের উপায় হিসেবে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ শুরু হয় ষাট/সত্তরের দশকে।
অধ্যাপক হক বলেন, “ষাট এবং সত্তরের দশকে এই ধারণা ছিল- যে মোড়ে গিয়ে গাড়ি রাস্তায় চলবে আর পথচারী ওপরে চলে যাবে। অনেক চেষ্টা করে শিক্ষিত দেশগুলোও মোড়ে এটি চালু করতে পারেনি।”
“পরে যেটা ঠিক করা হল যে, মোড়ে সিগন্যাল থাকবে, যেহেতু মোড়েই সবচেয়ে বেশি পারাপার হয় । পরে আড়াআড়িভাবে জেব্রা ক্রসিং দেয়া হল।”
তিনি বলেন, যেখানে সিগন্যাল নাই, দ্রুতগতির গাড়ি চলে সেখানে অবশ্যই ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশ এগুলো বিবেচনায় নেয়া হয়নি অনেকক্ষেত্রেই।
“ঢাকায় বেশিরভাগ কিন্তু অবৈজ্ঞানিকভাবে বানানো হয়েছে, মোড়ের মধ্যে বানানো হয়েছে, আসলে বানাতে হবে কোথায় সে জিনিসটায় কিন্তু জ্ঞানের অভাব আছে”, যোগ করেন তিনি।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, অনেক বয়স্ক মানুষ বা অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য এগুলো সহায়ক না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
“সবলদের জন্য বানানো হচ্ছে, দুর্বলরা কিভাবে যাওয়া-আসা করবে সেটা মাথায় রাখা হয়না। পরিকল্পিত না, ইনক্লুসিভ (সবার অন্তর্ভূক্তিমূলক) না। যেগুলো ইনক্লুসিভ সেগুলো আবার ইন-ফাংশনাল (অকার্যকর)।”
এই ধরনের ফুট ওভারব্রিজের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেছেন এই অধ্যাপক।
তিনি বলেন, সিগন্যাল ইন্সটল না করে মোড়ে ফুট ওভারব্রিজ চালানোর মানসিকতা সেকেলে। মোড়ে সিগন্যালই থাকবে আন্তর্জাতিকভাবে সেটাই এখন স্বীকৃত।
তিনি আরও জানান, রাতের বেলা ছিন্নমূল অনেকে এসব জায়গায় স্থান নেয়। ফলে তা অনেকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য কাজ করা হয়না”।
ফলে তার মতে ফুটওভারব্রিজ তৈরির পেছনে, “পয়সা খরচ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না, পথচারীদের কাজে আসছে না।”
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এরপরও এক মোড় থেকে আরেক মোড়ের মাঝামাঝি জায়গায় গাড়ির গতির কারণে সেসব জায়গায় ফুট ওভারব্রিজ কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এক্ষেত্রে তিনি ফার্মগেট এলাকায় ফুট ওভারব্রিজটির কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তার মতে, যখন এরশাদ সরকার রিকশা তুলে নিলো তখন থেকে ফার্মগেট এলাকার ফুটওভার ব্রিজটি কার্যকর হতে শুরু হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন