দেশে দানবীয় রূপে করোনা

জনগণ সচেতন না হলে করোনা আরো ভয়ংকর রূপ দেখাতে পারে। এমন শঙ্কা প্রকাশ করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশের সরকারের একার পক্ষে করোনা মহামারি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে সরকারের কিছু ভুল নীতিরও সমালোচনা করেছেন তারা।

এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরো ১৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ১১ হাজার ৫২৫ জন। যা এপর্যন্ত সবোচ্চ আক্রান্তের নতুন রেকর্ড। এছাড়া দেশে গত এক সপ্তাহে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজারের বেশি এবং শনাক্তের পরিমাণ ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে। শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের (২৯.৩০) কাছাকাছি। গত এক সপ্তাহের পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন জোট ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস্ অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন-গ্যাভি’র সদস্য এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ডিসেম্বর থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলো উল্টা-পাল্টা হয়ে গেছে।

যেমন-হোটেল রেস্তোরাঁ খোলা রাখা হয়েছে, অর্ডার দিয়ে খাবার সংগ্রহের শর্তে। কিন্তু ঢাকা শহরে রিকশা চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যাদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। এই রিকশাওয়ালারা কোথায় খাবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। তারা ফুটপাতে ২০-৩০ টাকা দিয়ে খিচুড়ি খেত। সেই খিচুরির দোকানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের পক্ষে তো আর দামি হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে খাবার কিনে খাওয়া সম্ভব না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।’

তার মতে, সাধারণ মানুষকে জোর করে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব না। এজন্য সকলের সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে বোঝানো এবং রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ততার একটা ব্যাপার আছে। এটা ব্যবহারিক একটা বিষয়। শুধু অর্ডার দিয়ে মানুষকে মাস্ক পরানো যাবে না। পুলিশ মাইকিং করে মামলা দিয়ে জোর করে স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগ করানো যায় না। এখানে তাদের সম্পৃক্ত করে তাদের আচরণ পরিবর্তনে সহায়তা করতে হবে। আর এভাবেই বাংলাদেশ অতীতের প্রতিটি মহামারি মোকাবিলা করে জয়ী হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘বাঁচার উপায় একটাই, আর তা হলো মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরিধানের জায়গায় নিয়ে আসা।

এজন্য স্থানীয় সরকার, মসজিদের ইমাম, কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠন সংস্থা এবং সর্বোপরি এনজিওগুলোকে একাজে সম্পৃক্ত করা। এনজিওদের সম্পৃক্ততা খুবই কম। অথচ তাদের সম্পৃক্ততা খুবই জরুরি। সরকার যা করছে মোটামুটি যথেষ্ট, কিন্তু অংশীদারিত্বটা বাড়াতে হবে।’

মহামারির শুরুর দিকে করোনায় সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ল্যাটিন আমেরিকার ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশকে। সেই বিপর্যয় কাটিয়ে বর্তমানে এসব দেশে করোনা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে রয়েছে। কিন্তু এরপরই প্রতিবেশী ভারতে ভয়ঙ্কর আঘাত হানে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।

ভারতের নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় সরকার সীমান্ত এলাকা সিলগালা করে দেওয়াসহ নানামুখি পদক্ষেপ নিলেও শেষ রক্ষা হয়নি বাংলাদেশের। গত এপ্রিলে দ্বিতীয় দফা লকডাউনের মাধ্যমে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও জনগণের অসচেতনতায় আবারো হু হু করে দেশে বিস্তার লাভ শুরু করে কোভিড-১৯ এর থাবা।

এদিকে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরো ১৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা দেশে একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ পর্যন্ত করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ৩৯২ জনের। এর আগের দিন ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যা ছিল দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রকাশিত গত সাতদিনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ৩০ জুন মৃত্যু হয় ১১৫ জনের এবং শনাক্ত হয় ৮ হাজার ৮২২ জন। এরপর চলতি মাসের প্রথম দিন শনাক্ত কিছুটা কমলেও একদিনের মৃত্যুতে নতুন রেকর্ড গড়ে। সর্বোচ্চ ১৪৩ জনের মৃত্যু হয় ১ জুলাই। এরপরের দুদিন মৃত্যু এবং শনাক্ত কিছুটা কমে আসে। ২ ও ৩ জুলাই মৃত্যু হয় যথাক্রমে ১৩২ ও ১৩৪ জনের এবং শনাক্ত হয় ৮ হাজার ৪৮৩ ও ৬ হাজার ২১৪ জন। তবে ৪ জুলাই মৃত্যুর সংখ্য দেড় শ ছাড়িয়ে ১৫৩ জনে পৌঁছে। সবশেষ ৫ জুলাই মৃত্যু এবং শনাক্তের নতুন রেকর্ড গড়ে দেশ। এদিন ১৬৪ করোনায় মারা যান ১৬৪ জন এবং শনাক্ত হয় ৯ হাজার ৯৬৪ জন। গতকাল মৃত্যুর নতুন রেকর্ড না গড়লেও শনাক্তের রেকর্ড রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৩৮ হাজার ৩৯ জনের। পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৩১টি। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। দেশে এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৬৭ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৩টি। মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ।

গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৬৩ জনের মধ্যে ৪৬ জনই খুলনার। এছাড়া ঢাকায় ৪৫, চট্টগ্রামে ২৪, রাজশাহীতে ২৪, বরিশালে ৬, সিলেটে ২, রংপুরে ১১ এবং ময়মনসিংহে ৫ জন মারা গেছেন।

মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯৮ জন পুরুষ এবং ৬৫ জন নারী। এদের মধ্যে ৫ জন বাসায় মারা গেছেন। তিন জনকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। বাকিরা হাসপাতালে মারা গেছেন। এ পর্যন্ত ভাইরাসটিতে মোট মারা যাওয়া ১৫ হাজার ৩৯২ জনের মধ্যে পুরুষ ১০ হাজার ৮৮৩ জন এবং নারী ৪ হাজার ৫০৯ জন।

এছাড়া, বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯১ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের ২৯ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ২৭ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ১১ জন এবং ২১ থেকে ৩০ বছরের ৫ জন রয়েছেন।