‘নিজেদের করা শিক্ষানীতিই উপেক্ষা করছে সরকার’
প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করাসহ জাতীয় শিক্ষানীতির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো আট বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে জাতীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, যা নিয়ে বিতর্ক চলছে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য সরকার গত আট বছরে কোনো বাজেটেই আলাদা বরাদ্দ রাখেনি। কার্যত এখন জোড়াতালি দিয়ে ও নির্বাহী আদেশে চলছে শিক্ষাব্যবস্থা।
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা আইন অপরিহার্য। শিক্ষানীতি মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেওয়ার পর সাড়ে সাত বছর ধরে শিক্ষা আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াই চলছে। এই সরকারের মেয়াদে শিক্ষা আইন হওয়া অনিশ্চিত। এই আইনটি না হওয়ার পেছনে প্রাইভেট ও কোচিং ব্যবসায়ীদের তদবিরকে বড় কারণ বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। তাঁরা বলেন, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত আটটি শিক্ষা কমিশন বা কমিটি হলেও বর্তমান শিক্ষানীতিটি বাদে বাকিগুলো হয় সরকার বদলের কারণে, নাহয় বিরোধিতার মুখে অকার্যকর হয়। কিন্তু ধারাবাহিকতা ও গ্রহণযোগ্যতাসহ সব দিক বিবেচনায় শিক্ষানীতিটি বাস্তবায়নে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল এই সরকার। অথচ কাজটি ঠিকভাবে করেনি সরকার।
শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য, শিক্ষকেরা বলছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ধীরগতি চলছে।
অবশ্য শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সম্প্রতি বলেছেন, শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন চলমান প্রক্রিয়া। শিক্ষা আইন প্রণয়নের কাজটিও প্রক্রিয়াধীন।
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০০৯ সালে ৮ এপ্রিল শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি হয়। তাদের সুপারিশে ২০১০ সালের মে মাসে মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদিত হয়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণে ২৪টি উপকমিটি গঠন করলেও বেশির ভাগ কমিটি কাজ করেনি। কোনো কোনো কমিটি কিছু কাজ করলেও সে আলোকে ব্যবস্থা হয়নি। তবে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা চালু, সবার জন্য নির্ধারিত কিছু বই রাখাসহ কয়েকটি বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা শুধুই নীতিতে
শিক্ষানীতি অনুযায়ী, চলতি ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম থেকে বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিশ্চিত করার কথা। এ জন্য সরকার পরীক্ষামূলকভাবে প্রায় ৬০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি চালু করে। এরপর কাজটি আর এগোয়নি। দেশে ৬৩ হাজার ৬০১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।
২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা যৌথ সভা করে ঘোষণা দিয়েছিল, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা হলো। এর ভিত্তিতে প্রাথমিক মন্ত্রণালয় বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা উঠিয়ে অষ্টম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাব করলে মন্ত্রিসভা নাকচ করে দেয়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা করার যুক্তি হলো, এই শিক্ষা শেষ করে বাস্তবজীবনে কাজে লাগবে। মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্তও হয়নি।
উপেক্ষিত শিক্ষানীতি!
শিক্ষানীতিতে বলা আছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং তৃতীয় থেকে সব শ্রেণিতে ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা চালু থাকবে। আর পঞ্চম শ্রেণি শেষে উপজেলা, পৌরসভা বা থানা (বড় শহর) পর্যায়ে সবার জন্য অভিন্ন প্রশ্নে সমাপনী পরীক্ষা হবে। আর অষ্টম শ্রেণি শেষে আপাতত জেএসসি পরীক্ষা নামে একটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয়ভাবে সারা দেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা হচ্ছে।
শিক্ষক ও অভিভাবকেরা বলছেন, এই পরীক্ষার নামে শিশুদের ওপর ‘বোঝা চাপিয়ে’ দেওয়া হয়েছে। কোচিং-প্রাইভেট টিউশন ও সহায়ক বইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, পঞ্চম শ্রেণি শেষে জাতীয়ভাবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা নেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। আদতে এই পরীক্ষা তেমন কাজেও আসছে না। বরং গবেষণায় দেখা গেছে কোচিং-প্রাইভেট ও নোট-গাইডের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা হলে শিক্ষার মানের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে ভাগ করে দুটি আলাদা অধিদপ্তর যথাক্রমে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর করার কথা ছিল শিক্ষানীতিতে। কিন্তু সেটি না করে উল্টো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দুটি বিভাগ করা হয়েছে। অথচ কাজের চাপ অধিদপ্তরেই বেশি। তবে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর হয়েছে।
শিক্ষানীতি অনুযায়ী, সব শিক্ষকের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো, স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির আদলে কমিশনও হয়নি।
এ মেয়াদে শিক্ষা আইন হচ্ছে না!
২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়নের জন্য কমিটি হলেও গত সাড়ে সাত বছরে কেবল খসড়া কাটাছেঁড়াই হয়েছে, চূড়ান্ত হয়নি। সর্বশেষ খসড়ায় কোচিং, প্রাইভেট ও সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর কোচিং ও প্রাইভেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আইনটি ঠেকাতে তৎপরতা শুরু করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বাকি মেয়াদে আইনটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, তাঁর মূল্যায়ন হলো শিক্ষানীতির মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষানীতির অনেক বিষয় আছে, যা বাস্তবায়নে আইন অপরিহার্য। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেটা হলো না।-প্রথম আলো’র সৌজন্যে প্রকাশিত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন