নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরীক্ষায় ফেলবে ‘কোন্দল’

অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং মন্ত্রী-সাংসদদের সঙ্গে স্থানীয় সংগঠনের নেতাদের দূরত্ব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের পরীক্ষায় ফেলতে পারে আওয়ামী লীগকে। এই দুশ্চিন্তা খোদ আওয়ামী লীগের। আরও উদ্বেগের বিষয়, এই কোন্দল হয়ে উঠছে প্রাণঘাতী। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নকে ঘিরে এই প্রবণতা আরও বাড়তে পারে।

রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানি নিয়ে আইনি সহায়তা ও মানবাধিকার-বিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসহযোগী সংগঠনগুলোর ভেতরের কোন্দল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে সারা দেশে রাজনৈতিক হানাহানিতে মারা গেছেন ৫২ জন। এর মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই মারা গেছেন ৪৩ জন। এ ছাড়া, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে রাজনৈতিক কারণে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে; যার ৭ জনই আওয়ামী লীগের এবং তাঁরা নিজেদের মধ্যে কোন্দলে মারা গেছেন।

দল টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়েছে বলে মনে করছেন দলীয় নীতিনির্ধারকেরা। আগামী নির্বাচনে এটা নৌকা মার্কাকে সমস্যায় ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।

কোন্দলের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে গত সোমবার দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও। মনোনয়ন নিয়ে মন-কষাকষি কোথায় আছে, তা খুঁজে বের করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নপ্রক্রিয়া আগামী সেপ্টেম্বর থেকেই শুরু করার কথা জানান তিনি। কারণ, বাছাইপ্রক্রিয়ায় ভুল থাকলে তা সংশোধন এবং কোন্দল নিরসনে বেশি সময় পাওয়া যাবে-এই বিবেচনাতেই আগাম মনোনয়নপ্রক্রিয়া শুরু করার পরিকল্পনার কথা জানান দলীয় প্রধান।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কোন্দল নিরসন এবং নেতায় নেতায় ও নেতা-কর্মীদের মধ্যে দূরত্ব কমানোর লক্ষ্যেই তৃণমূলের নেতাদের ঢাকায় ডেকে আনা হয়। গত ২৩ জুন থেকে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে তিনটি বর্ধিত সভা করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। সভাগুলোতে তৃণমূলের নেতাদের বক্তব্যেও বিভেদ, মন্ত্রী-সাংসদদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দূরত্ব এবং দলে অনুপ্রবেশের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বিভেদ ভুলে সবাইকে ঘরে ঘরে গিয়ে নৌকার জন্য ভোট চাইতে নির্দেশনা দেন।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১০ বছরের শাসনামলে মন্ত্রী-সাংসদ ও বড় নেতাদের প্রতি স্থানীয় নেতাদের যে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে, বর্ধিত সভায় তা প্রকাশ পেয়েছে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কাছে এই ক্ষোভের বিষয়টি অজানা ছিল না। এ জন্যই তিনি তৃণমূলের নেতাদের ডেকে বলেছেন, তাঁরাই দলের প্রাণ। তাঁদের মন্ত্রী-সাংসদেরা সম্মান না দিলেও প্রধানমন্ত্রী নিজে সম্মান দেন। তাঁদের গণভবনে দাওয়াত করে এনেছেন। এর ফলে মন্ত্রী-সাংসদেরা কিছুটা চাপে থাকবেন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, এরপর দলের সর্বস্তরের নারীদের নিয়েও গণভবনে আরেকটি বর্ধিত সভার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো দিন-তারিখ ঠিক হয়নি। এতে মহিলা আওয়ামী লীগ, সহযোগী মহিলা সংগঠন, নারী সাংসদ, সারা দেশে নির্বাচিত দলীয় নারী জনপ্রতিনিধিদের ডাকা হবে।

মনোনয়ন-যুদ্ধ শুরু
আগামী ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার আলোচনা আছে। এই হিসাবে নির্বাচনের বাকি আর ছয় মাস। এখনই সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। কথার লড়াই, বিষোদ্গার, এমনকি মারামারি পর্যন্ত হচ্ছে। তিন পর্বের বর্ধিত সভায় এর আঁচ কিছুটা হলেও দেখা গেছে।

তিন দিনের সভায় স্বল্পসংখ্যক স্থানীয় নেতা বক্তৃতা করতে পেরেছেন। তবে প্রায় দেড় হাজার নেতার অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ ও চাওয়া-পাওয়ার কথা লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়ে গেছেন। এখন এসব চিঠি পড়ে করণীয় ঠিক করবে দল। পাশাপাশি সাংগঠনিক প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে ছয় মাস অন্তর জরিপ করছেন। জরিপের ফলও মনোনয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। দলের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এবার মনোনয়নে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। সাধারণত এক নির্বাচন থেকে অন্য নির্বাচনে গড়ে ৫০ জন মন্ত্রী-সাংসদ বাদ পড়ে থাকেন। এবার ৭০-৮০ জন বাদ পড়বেন, এমন আলোচনা আছে দলে।

নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার গন্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ওই ইউপির চেয়ারম্যান সাজিদুল ইসলাম ওরফে সানজু মিয়া ৭ জুলাইয়ের বর্ধিত সভায় তাঁর এলাকার সাংসদ (নেত্রকোনা-৩) ইফতিকার উদ্দিন তালুকদারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, সাংসদ নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। দলের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ওই আসন থেকে দীর্ঘদিন ধরে মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। এই নিয়ে সাংসদ ও অসীম কুমার উকিলের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই আছে। সাবেক সাংসদ মঞ্জুর কাদের কোরাইশী ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা শামসুল কবির খানও এই আসনে আগ্রহী।

এ বিষয়ে সাজিদুল ইসলাম বলেন, উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ৩ টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। বিএনপি ৪ টিতে। অন্যরা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। এই থেকেই বোঝা যায়, দলের ভেতরে কী অবস্থা চলছে।

২৩ জুনের সভায় ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সমস্যা হচ্ছে কোন্দল। দলের নেতারা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না। চেহারাও দেখতে চান না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারানোর জন্য আওয়ামী লীগই যথেষ্ট।

বেনজির আহমেদের বাড়ি ধামরাইয়ে। এই আসনে তিনি ২০০৮ সালে সাংসদও ছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সাংসদ হন আবদুল মালেক। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। বেনজির আর মালেকের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট। দুজনই এবার এই আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী।

জানতে চাইলে বেনজির আহমেদ বলেন, এক আসনে পাঁচ-সাতজন মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলে কিছুটা তো সমস্যা হয়। তবে এগুলো সমন্বয় করা সম্ভব।

অনুপ্রবেশ নিয়ে চিন্তা
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্বাধীনতার পর সম্ভবত গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। দলীয় কোন্দলে নিজের পক্ষ ভারী করতে জামায়াতে ইসলামীর নেতা, মামলার আসামি, টেন্ডারবাজ, এমনকি মাদক ব্যবসায়ীকেও কেউ কেউ দলে ভিড়িয়েছেন।

২০১৬ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয় সাংসদ আবদুল ওদুদের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন স্থানীয় জামায়াতের নেতা ও সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান সোহরাব আলী। তাঁর বিরুদ্ধে তখন একাধিক নাশকতার মামলা ছিল। এর আগে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে আগে কুষ্টিয়া জামায়াতের নেতা নওশের আলী আওয়ামী লীগে যোগ দেন স্থানীয় সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফের হাত ধরে। এই দুই ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। এরপর দলীয় প্রধান অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এতেও কাজ হচ্ছে না বলে নেতারা জানিয়েছেন।

২৩ জুন গণভবনের বর্ধিত সভায় জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাকী বিল্লাহ বলেন, ‘নতুন করে অনেকে নৌকায় ওঠার কারণে আমাদের কাপড় ভিজে যাচ্ছে। জিয়া আর মোশতাকের প্রেতাত্মারা নৌকার ওপর ভর করেছে। এটা অব্যাহত থাকলে নৌকার সলিলসমাধি হবে।’

দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যেহেতু আমরা ক্ষমতায়, বিভিন্ন দল থেকে অনেকেই ছুটে আসবে। গ্রুপিং করার জন্য বাছবিচার ছাড়াই অনেকে যাকে পাচ্ছে তাকে নিয়ে নিজের শক্তি দেখাতে চায়। এরা আসে মধু খেতে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারা ভাবে এখানে (আওয়ামী লীগ) এলে মামলা থেকে বাঁচতে পারবে।’ যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং বাঁচার জন্য দলে এসেছেন, তাঁদের তালিকা আছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।

সার্বিকভাবে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকলে কিছু সমস্যা হয়। এগুলো নিরসনে দল কাজ করছে। তৃণমূল নেতাদের এটা বলে দেওয়া হয়েছে যে যোগ্য লোককেই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে। এরপরও কোনো সমস্যা থাকলে আলোচনা হবে। তবে সবাইকে নৌকার জন্য কাজ করতে হবে। সূত্র : প্রথম আলো