পাবনার বাজারে বাজারে রঙিন রসালো লিচু
পাবনার ঈশ্বরদী লিচুর রাজধানী হিসেবে সারাদেশে পরিচিত। এ অঞ্চলের রসালো মিষ্টি লিচুর বেশ কদর রয়েছে দেশব্যাপী। পাবনায় এবারে লিচুর বেশ বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে দাম নিয়ে চাষি ও বাগানীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ কেউ বাজারদরকে স্বাভাবিক বললেও অনেকেই হতাশার কথা জানিয়েছেন।
এদিকে, ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন লিচুর হাটগুলোতে বেচাকেনা বেশ জমেছে উঠেছে। জেলার সবচেয়ে বড় লিচুর হাট আওতাপাড়ায়। ভোরের সূর্য উঠার আগেই হাটে বেচাকেনা শুরু হয়ে চলে সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত। বাজারে আটি লিচু আসলেও বোম্বাই জাতের লিচু বাজারে আসতে আরও দুই থেকে তিনদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
সরেজমিনে ঈশ্বরদীর শিমুলতলা হাট, আওতাপাড়া হাট ও ছলিমপুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, আটি জাতের লিচুর প্রকারভেদে ১২০০-১৮০০ টাকা পর্যন্ত কৃষকদের থেকে আড়তদাররা ক্রয় করছে। আড়তদার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত ব্যবসায়ীরা ক্রয় করছে।
পাবনা জেলা জুড়ে বিদেশি ও হাইব্রিড বোম্বে লিচু ও দেশীয় আটি জাতের লিচুর বাগান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা দেশীয় প্রজাতির আটির লিচু ভাঙতে শুরু করেছেন। বোম্বাই লিচু ভাঙনে এখনো কয়েকদিন সময় লাগবে। প্রায় বাজারের আনাচে কানাচে লিচুর সমারোহ শোভা পাচ্ছে।
জানা যায়, ঈশ্বরদী উপজেলার আওতাপাড়া, বাঁশেরবাদা, সদর উপজেলার চকউগ্রগড়, জোয়ারদহ, হামিদপুর, ছলিমপুর, মানিকনগর, জয়নগর, মিরকামারি, জয়কৃষ্ণপুর, উগ্রগড়, মৌগ্রাম এবং আটঘরিয়া উপজেলার গোপালপুর, ত্রিমোহন, পরানপুর, হিদাশকোল, চাচকিয়া, ষাটগাছা, ডেঙ্গারগ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে সারিসারি এমন লিচুর বাগান। সারাদেশের লিচুর চাহিদার একটি বড় অংশের যোগান আসে এসব গ্রাম থেকে। প্রতি বছর ৬ থেকে ৭শ’ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয় এই জেলা থেকে।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি সূত্রে জানা যায়, জেলার ঈশ্বরদী পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে লিচু গাছ রয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ টি। বিঘা প্রতি ২০টি থেকে ১৫টি গাছ অর্থাৎ ১ একর জমিতে ৪২টি, ১ হেক্টর জমিতে ৯০টি গাছ হয়। লিচু আবাদি কৃষকের সংখ্যা ৯ হাজার ৬২০ জন। বাণিজ্যিক আকারে বাগান ২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। বিচ্ছিন্নভাবে বসতবাড়িতে আবাদ রয়েছে ৫৫০ হেক্টর। ফলন্ত আবাদি জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমি।
এদিকে, ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার লিচুর ভরা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিন সকাল ১০টা বাজতে না বাজতেই ঈশ্বরদীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি অতিক্রম করে, দুপুর নাগাদ ৩৬ থেকে ৩৮-৪০ ডিগ্রির মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। ফলে এই আবহাওয়া লিচুর জন্য প্রতিকুল ছিল। ফলে গাছে প্রচুর লিচু আসলেও আকারে ছোট হয়েছে।
ঈশ্বরদীর চরমিরকামারী লিচু চাষি ঈসমাইল হোসাইন সরদার জানান, তার ১২ বিঘার উপরে একটি লিচু বাগান আছে। প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেন তিনি। এ বছর ফলন ভাল হয়েছে। আটি জাতীয় লিচুর দাম আমানুরুপ একটু কম হলেও বোম্বাই লিচুতে অধিক দাম পাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
ঈশ্বরদীর জয়নগর হাটে কথা হয় আওতাপাড়ার লিচু চাষি বাদশা মোল্লার সাথে। তিনি বলেন, ৩০ বিঘা জমির উপর ৭৮ টি লিচু গাছ রয়েছে। ১০ বিঘা জমিতে আটি জাতের লিচুর আবাদ রয়েছে। বাকি বাগানগুলোতে বোম্বাই লিচু চাষ হয়েছে। আটি জাতের লিচুর মধ্যে ৬ বিঘা লিচু বাজারে এনে বিক্রি করে দিয়েছি। দাম কম হলেও ফলন ভাল হওয়াতে খরচ যোগাতে তেমন সমস্যা হবে না।
আওতাপাড়া হাটে কথা হয় বরিশাল থেকে আসা বোরহান উদ্দিন ও কুমিল্লা থেকে আসা মনিরের সাথে।
তারা বলেন, ‘প্রতি বছরই আমরা এখানে এসে লিচু কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে থাকি। আমরা এসব লিচু খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা অঞ্চলে পাঠাই। এবার বাগানে ফলন ভালো হওয়ায় বাজারে প্রচুর লিচু আসছে। দামও মোটামুটি নাগালের মধ্যেই আছে।’
এদিকে, লিচুর ভাঙতে প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। এতে অনেক বেকার যুবক ও শিক্ষার্থীদের আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে লিচু বাগানে ভোর থেকে সন্ধা পর্যন্ত শ্রমিকের কাজ করছে। বাড়ির অনেক বয়স্ক, মধ্য বয়সী নারীদেরও লিচুর পাতা ছেঁড়ার কাজ করতে দেখা গেছে।
কথা হয় লিচু ভাঙতে আসা রুমা ও আসমা খাতুনের সাথে তরা বলেন, এ সময় বাড়িতে তেমন কাজ-কর্ম নেই, তাই বাড়ির পাশে লিচু বাগানে আটি বাঁধা ও পাতা ছেঁড়ার কাজ করছি। সকাল ৭ টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত এখানে কাজ করে ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা পাই।
ঈশ্বরদীর বাঁশেরবাদা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহান বলেন, ‘এখন আমার স্কুল ছুটি রয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাই ছুটির মাঝে লিচুর বাগানে কাজ করছি। প্রতিদিন ৫শ টাকা করে হাজিরা পাই। এতে পড়ালেখার কিছু খরচ জোগাড় হয়।’
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারি উপপরিচালক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ জানান, এবার পাবনায় ৪ হাজার ৭৩১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। এতে ৪০ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন লিচুর ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু ফলন ভালো হওয়ায় সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর লিচুর রাজধানী খ্যাত পাবনার ঈশ্বরদী। এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল লিচু, এটা চাষ করেই অধিকাংশ মানুষের সারা বছর তাদের সংসার চলে। গত বছরে ফলন ভালো না হওয়ায় চাষিরা খুব একটা লাভবান হননি, কিন্তু এবার ফলন ভালো হওয়ায় চাষি ও বাগানীরা বেশ লাভবান হবেন বলে আমি আশাবাদী।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন