পুরান ঢাকায় বার বার কেন এমন ভয়াবহ দাবানল?
আজ থেকে নয় বছর আগে ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক কারখানায় একই ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রাণ হারিয়েছিলেন শতাধিক মানুষ।
সেই ভয়াবহ ঘটনার কথা পুরনো ঢাকার মানুষ এখনও ভুলতে পারেন নি।
সেই অগ্নিকাণ্ডের পর পুরনো ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক কারখানা এবং গুদাম সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত তা হয়নি। ফলে তাদের আবার পড়তে হলো আরেকটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে।
পুরনো ঢাকার এমন ভয়াবহ দাবানল কেন থামানো যাচ্ছে না? এই প্রশ্ন এখন উঠছে।
নিমতলীতে রাসায়নিকের আগুনে পুড়ে বহু মানুষের হতাহতের ঘটনার পর চকবাজারের একজন বাসিন্দা ক্যামেলিয়া চৌধুরী পুরোনো ঢাকায় রাসায়নিক দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সরকার বা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি শুনলেও সেই নিমতলীর ঘটনার পর নয় বছরেও সে সব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন তিনি দেখেন নি।
বরং ক্যামেলিয়া চৌধুরী চকবাজারে তার নিজের বাসভবন থেকে অল্প দূরত্বেই নিমতলীর ঘটনার যেনো পুনরাবৃত্তি দেখলেন। সরকার, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এমনকি স্থানীয় মানুষ-কেউই এমন পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারে না বলে তিনি মনে করেন।
“এর ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখুন, আমি বাড়িওয়ালা, আমার আয় কম। আপনি আমাকে পাঁচ লাখ টাকা আগাম দিচ্ছেন। আমিও টাকার লোভে তা নিচ্ছি। উপরতলায় আমি বাড়িওয়ালা থাকছি, আমার ফ্যামিলি আছে। দোতলায় একটা জুতার কারখানা আর নিচে জুতা তৈরির জন্য আঠার গোডাউন। এটা ঝুঁকি। একটা সিগারেট ধরিয়ে দিলেই তো আগুন লেগে যাবে। পুরনো ঢাকার পুরোটা চিত্রই এ রকম। সরকার বা প্রশাসন থেকে এখানে আইন প্রয়োগ না করলে এটা হবে না।”
রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই কি সব উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে?
নিমতলীর ভয়াবহ ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ে সরকার চাপের মুখে পড়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে তখন পুরোনো ঢাকায় ৮০০’র বেশি অবৈধ রাসায়নিক গুদাম এবং কারখানা চিহ্নিত করে সেগুলো কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি এবং পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনকারী আবু নাসের খান বলছিলেন, পুরোনো ঢাকায় যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্যের কয়েক হাজার গুদাম, কারখানা বা দোকানের বেশিরভাগের নিবন্ধন বা লাইসেন্সসহ কোনো কাগজপত্র নেই। এইসব ব্যবসায়ী এবং তাদের সহায়তাকারী স্থানীয় লোকজনের ভোটব্যাংক রয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কর্তৃপক্ষ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয় না বলে তিনি মনে করেন।
“তারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিভাবেও শক্তিশালী। এবং এই এলাকার ভোটব্যাংক হিসাবে নানাদিকে প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায় না।এছাড়া ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা পরিবেশ অধিদপ্তর তারাও সেভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সিটি করপোরেশন যারা এসবের লাইসেন্স দেয় বা তদারকি করে, তারাও সেটা সঠিকভাবে করেনি। এরা আসলে দায়ী।”
কেউ লাইসেন্স নিলে তার শর্ত কি তারা পূরণ করছে?
লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রেও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা বা নিরাপত্তা সহ অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়। দমকল বাহিনী একজন সাবেক কর্মকর্তা সেলিম নেওয়াজ ভূইয়া তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, পুরোনো ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসায়ী যাদের লাইসেন্স আছে, তারাও শর্তগুলো পূরণ করেন না।
রাসায়নিক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মুহিবুর রহমান নিমতলীর ঘটনার পর সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার কাজ করেছিলেন। তার বলেছেন, এখানে সরকারের দায় বেশি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
“আমার মনে হয়, সরকার এবং আমরা কেউই বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি না।”
নিমতলীর ঘটনার সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারে শিল্প মন্ত্রী ছিলেন দিলীপ বড়ুয়া। সে সময় তিনি অবৈধ রাসায়নিক ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো এবং এসব স্থানান্তরের কথা বললেও বাস্তবায়ন করতে পারেন নি। কিন্তু তিনি ব্যর্থতার দায় নিতে রাজি নন।
“তখন তো অভিযান হয়েছিল। তারা নীতিগতভাবে ঠিক করেছিল, তারা চলে যাবে। আমরা জায়গা ঠিকে করে দেবো। তারা তাদের অর্থায়নে সেটা তৈরি করবে। আমরা কেরানীগঞ্জে সে রকম জায়গাও ঠিক করেছিলাম । এর আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো করতে গিয়ে আমার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর যারা কর্মকর্তা ছিলেন, তারা আর তা ফলোআপ করেননি। ফলে হয়নি।”
এদিকে এখন আবার চকবাজারে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর সরকারের মন্ত্রীরা রাসায়নিক ব্যবসা কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করাসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি তুলে ধরছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন