ফোরজি দুনিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ
চতুর্থ প্রজন্মের তারবিহীন টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি বা ফোরজি চালু এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ টেলিযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) টেলিকম অপারেটরদের কাছে ফোরজি লাইসেন্স হস্তান্তর করবে।
এরই মধ্যে অপারেটররা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তবে সবচেয়ে এগিয়ে সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন। লাইসেন্স প্রাপ্তির ১৫ মিনিটের মধ্যে ফোরজি চালু করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে তারা।
তবে ফোরজি চালু হলেও তার সুবিধা গ্রাহকরা পেতে কিছুটা সময় লাগবে বৈকি। গ্রাহকদের হাতে নেই পর্যাপ্ত ফোরজি নেটওয়ার্ক সমর্থিত হ্যান্ডসেট। আবার থ্রি জি সিম পাল্টে নতুন সিম নিতে হবে। অপারেটরগুলো বেশ কিছু দিন ধরেই সিম পাল্টে নেয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করলেও এ ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি নেই।
প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, ফোরজি প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে তা দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।
ফোরজির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুতগতির ইন্টারনেট। ফলে এটি চালু হলে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সার্ভিস ব্যবহার করা যাবে সহজে।
ফ্রিল্যান্সিংসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক পেশার সঙ্গে জড়িতদের জন্যও ফোরজি হতে পারে আশীর্বাদ স্বরূপ। দেশের প্রতিটি প্রান্তে ফোরজি পৌঁছে গেলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
দ্রুতই গ্রাহকদের কাছে ফোরজির সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার কথা জানালেন বাংলালিংকের ডিরেক্টর অব কম্যুনিকেশনস আসিফ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে ফোরজি একটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করি।’
বাংলালিংক ১৩ নভেম্বর বিটিআরসি আয়োজিত তরঙ্গ নিলামে অংশ ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কেনে। এছাড়াও অপারেটরটি১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কেনে। বর্তমানে বাংলালিংকের বিভিন্ন ব্র্যান্ডে তরঙ্গের পরিমাণ ৩০.৬ মেগাহার্টজ।
দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণ ফোনে তরঙ্গের পরিমাণও বেশি। তাদের হাতে রয়েছে ৩৭ মেগাহার্টজ তরঙ্গ রয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক মনে করেন, দেশে ফোরজি চালু হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কৃষিসহ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে ব্রডব্যান্ড কানেকটিভিটি সবার জন্য অ্যাভেলেবল করা আমাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। আমরা চাই ২০২১ সাল নাগাদ ১০০ ভাগ ইন্টারনেট পেনিট্রেশন এবং ৫০ ভাগ ব্রডব্যান্ড পেনিট্রেশন। অর্থাৎ হাইস্পিড ব্রডব্যান্ড কানেকটিভিটি সব নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করতে চাই।’
‘আমরা ২৬ শ ইউনিয়নে হাইস্পিড ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট নিয়ে যাচ্ছি। তাই ফোরজি এলে যেটা হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কৃষি ও কর্মসংস্থানে একটা আমূল পরিবর্তন আসবে। ফোরজি নেটওয়ার্ক থাকলে আমরা গ্রাম ও শহরে শিক্ষার বৈষম্য ও প্রযুক্তির বৈষম্য দূর করতে পারব। পাশাপাশি কৃষি এবং স্বাস্থ্য এই দুই ক্ষেত্রেও টেলিমেডিসিন বলুন ভিডিও কনফারেন্স বলুন তখন গ্রাম ও শহরে শিক্ষার মান ও বৈষম্য আছে সেটা দূর করতে পারব।’
গ্রাহকের বাড়তি খরচের বোঝা
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) সাবেক সহ-সভাপতি এবং ট্রানশান বাংলাদেশ লিমিটেডের সিইও রেজওয়ানুল হক রেজওয়ানুল হক মনে করেন ফোরজি নেটওয়ার্ক উপভোগ করতে হলে গ্রাহকদের বাড়তি খরচ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘থ্রিজি ও ফোরজি হ্যান্ডসেটের মূল্যের পার্থক্য প্রায় ১ হাজার থেকে ১৫ শ টাকা। দেশে যেহেতু এখনও ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু হয়নি, তাই একজন ক্রেতা এতদিন ১ হাজার থেকে ১৫ শ টাকা বেশি খরচ করে ফোরজি এনাবল হ্যান্ডসেট কিনত না। ফলে বেশিরভাগের হাতেই স্মার্টফোনগুলো থ্রি জি নেটওয়ার্ক উপযোগী।
‘আবার ফোরজি হ্যান্ডসেটের বাজারও এখনো প্রস্তুত নেই। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, দেশে শুধু ফোরজি নেটওয়ার্ক সুবিধা চালু করলেই হবে না। এটাকে শুধু কমিউনিকেশনের জন্য বা কথা বলার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলে হবে না। এটাকে প্রোপার ইউটিলাইজড করতে হবে।’
গ্রামীণফোনের ডেপুটি সিইও ইয়াসির আজমান বলেন, ‘আমরা গত ছয় মাস ধরে ফোরজি সিম বিক্রি করে আসছি। ফলে গ্রাহকদের নতুন করে ফোরজি সিম কিনতে হচ্ছে না। কিন্তু যারা গ্রামীণফোনের পুরাতন গ্রাহক রয়েছেন তাদের ফোরজিতে আসতে হলে সিম পরিবর্তন করতে হবে।’
দেশে ফোরজি হ্যান্ডসেটের সহজলভ্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে আজমান বলেন, ‘গ্রামীণফোন সুলভে ফোরজি হ্যান্ডসেট এনেছে। ফলে গ্রাহকদের খুব বেশি একটা হ্যান্ডসেটের জন্য খরচ করতে হচ্ছে না।’
দেশে ফোরজি এনাবল হ্যান্ডসেটের ঘাটতি রয়েছে, তাই এই মুহূর্তে ফোরজির সুবিধা কতটা মিলবে? এমন প্রশ্ন ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের হাতে এখনও ফোরজি এনাবল হ্যান্ডসেট নেই। এ বিষয়টি সত্য। তবে এখনকার বেশিরভাগ হ্যান্ডসেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থ্রিজি ও ফোরজি এনাবল হ্যান্ডসেট তৈরি করছে। আমরা এখন টুজি নয়, থ্রিজি ও ফোরজি এনাবল হ্যান্ডসেট ও বিটিএস প্রভাইড করব।
‘দেশীয় হ্যান্ডসেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আহ্বান জানাই, তারা যাতে কম দামে ফোরজি উপযোগী মোবাইলসেট গ্রাহকদের হাতে তুলে দেন।’
গতি কত হবে?
দেশে থ্রি জি নেটওয়ার্কে গতি পর্াপ্ত ছিল না বলে সমালাচনা আছে। টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রী হওয়া আগে মোস্তফা জব্বার এই বিষয়টি নিয়ে উচ্চকিত ছিলেন।
ফোরজি কাঙ্খিত হলেও অপারেটরগুলো ফোরজির কাঙ্খিত গতি দিতে পারে কি না-সেটা দেখার অপেক্ষায় মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যে হারে গ্রাহক বাড়ছে সেই হারে অপারেটরদের সেবা বাড়ছে না। আমি মনে করি তাদের কাছে যে তরঙ্গ রয়েছে তা দ্রুতগতির ফোরজি সেবা দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তাদের দরকার ছিল আরও বেশি তরঙ্গ। এজন্য আমি টেলিকম অপারেটরগুলোকে আহ্বান জানাব আরও বেশি তরঙ্গ দেবার।’
গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ছাড়াও ফোরজি সেবা দিতে প্রস্তুত টেলিটক ও রবি। যদি তারা তরঙ্গ নিলামে অংশ নিয়ে তরঙ্গ কেনেনি।
দেশে এখন মোবাইল ফোন গ্রাহক ১৪ কোটি ৫১ লাখ ১১ হাজার। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য মতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এরাই সক্রিয় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী।
বিটিআরসির তথ্য বলছে দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন। অপারেটরটির গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি ৫৩ লাখ ২৭ হাজার। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে রবি। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক চার কোটি ২৯ লাখ ৮ হাজার। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলালিংক। তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটি ২৩ লাখ ৮৪ হাজার। দেশের একমাত্র সরকারি মোবাইল অপরেটর টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা ৪৪ লাখ ৯৪ হাজার।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন