বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া আমার প্রথম শিক্ষা : প্রণব মুখার্জী
প্রণব মুখার্জী : বর্তমান বাসভবন ১০ নম্বর রাজাজি মার্গে উঠেছি কিছুদিন হলো। সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামও অবসর নেওয়ার পর এ বাংলোয় থাকতেন। রাজধানী দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন এবং নর্থ ও সাউথ ব্লকের নির্মাতা ব্রিটিশ স্থপতি এডোয়ার্ড ল্যুটিয়েন এ বাংলোতেই বাস করতেন। দোতলা বাংলোর একতলায় বসার ঘর। সেখানকার বড় কাঠের টেবিলটা দেখলে আরেকটা টেবিলের কথা মনে পড়ে।
আমি যখন প্রথম অর্থমন্ত্রী হই, তখন আমার টেবিলটা ছিল অতিকায়। সে টেবিলের একটা ইতিহাস আছে। ভারতের প্রথম অর্থমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এ টেবিলে বসতেন। পরে তিনি পাকিস্তান চলে যান। শুনেছি, ভারত ভাগ হওয়ার সময় তার পূর্বাভাস ছিল- পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানকে বোধহয় বেশিদিন একত্রে রাখা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে পূর্বাভাস সত্যে রূপান্তর করেছিলেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বাঙালিত্ব কখনও ভুলতে পারি না। রাইসিনা হিলসের রাষ্ট্রপতি ভবনে এই প্রথম একটি বাংলা বইয়ের গ্রন্থাগার তাই গড়ে উঠেছে আমার আমলে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বহু পুস্তক রয়েছে।
রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। আমার কাছে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হলে এ গ্রন্থটি একমাত্র প্রামাণ্য দলিল। আজও আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হই, বাঙালি হিসেবে তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আসলে নিজের জাতিসত্তা সম্পর্কে গর্ববোধ না থাকলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সেটিই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে আমার প্রথম শিক্ষা।
অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে আমি যতটুকু জানি, তার চেয়ে অনেক বেশি জানতেন রাজনীতিতে আমার আদর্শ ইন্দিরা গান্ধী। মনে আছে, ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে একবার সতর্ক করেছিলেন জীবন-সংশয় নিয়ে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল- ‘ওরা আমারই সন্তান। আমাকে কেন হত্যা করবে?’ অথচ সেই সেনাবাহিনীর একাংশের হাতেই তার মৃত্যু হয়।
এরই মধ্যে তার হত্যাকাণ্ডের বিচারও হয়েছে। কিন্তু আমার মনে এখনও সন্দেহ রয়েছে, হত্যার ষড়যন্ত্র কতটা উদ্ঘাটন করা গেছে। সাধারণভাবে হত্যাকারী কারা এখন আমরা সবাই জানি। কিন্তু তার হত্যাকাণ্ডের পেছনের ষড়যন্ত্র নিয়ে প্রকৃত তদন্ত আজও সমাপ্ত হয়নি। প্রকৃত রহস্য এখনও উদ্ঘাটিত হয়নি।
আমরা দেখেছি, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশের সৃষ্টি করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেননা, তিনি অত্যন্ত উদার নীতির প্রবর্তক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি লাহোর যান। পাকিস্তান শাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।
তার অবশ্য মূল কারণ ছিল- যেসব বাঙালি তখনও পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিলেন, তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যই ছিল প্রধান। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল জোটনিরপেক্ষ। পাকিস্তানবিরোধী বলেই ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় মিসরের পক্ষ নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হলে আমার প্রথমেই মনে পড়ে তার ভাষণের কথা। আমি বলতে পারি, এ ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ জননেতা। তার বাগ্মিতার তুলনা মেলা ভার। পরে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক নেতা হয়ে উঠছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ার দুর্ভাগ্য যে, এ ধরনের জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতাদের অকালেই প্রাণ হারাতে হয়। বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বন্দরনায়েকে- এরা জীবিত থাকলে আজ হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার চেহারা অন্যরকম হতো। দূরদর্শীসম্পন্ন এ ধরনের রাষ্ট্রনেতাদের আজ বড়ই অভাব।
যেদিন তাকে হত্যা করা হয়, সেদিন আমি দিল্লিতে ছিলাম না; কলকাতায় ছিলাম। আকাশবাণীর সংবাদে খবরটা জানার পর আমি বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি। স্বজন হারানোর মতো শোকাকুল হয়েছিলাম। পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ফোন পেয়ে দিল্লি ছুটে যাই। মনে হয়েছিল, যে অশুভ শক্তি মুজিবকে হত্যা করেছে, তারা হয়তো সেখানেই থেমে থাকবে না।
নব্যসৃষ্ট বাংলাদেশকে ফের অন্ধকার রাজত্বে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তাই ভারত সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। আমাদের সৌভাগ্য, মুজিবের সুযোগ্য কন্যা হাসিনা-রেহানা সেদিন ঢাকায় ছিলেন না। তাই আজ বাংলাদেশ ফের মুজিব আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। আমি বলি মুজিবসিজম। সেটিই তার দর্শন; বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতা পাওয়ার জন্য মুজিবকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করতে হয়। ফলে নব্যসৃষ্ট বাংলাদেশের প্রশাসনের যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তাতে অনেকেই তাকে উপযুক্তভাবে সহযোগিতা করেননি। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল, বাংলাদেশের কেউ তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। সে ধারণা তার ভ্রান্ত ছিল। সেটা জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে হলো; কিন্তু বিশ্ব হারাল যোগ্যতম নেতা।
বলে রাখি, প্রথম থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি যখন লন্ডন থেকে দিল্লি আসেন, তখন প্রথম সম্মুখ সাক্ষাৎ। দীর্ঘদেহী ও বজ্রকণ্ঠের মানুষটিকে দেখে শ্রদ্ধায় মন ভরে গিয়েছিল। অনেক কথা হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন আমাকে দেখিয়ে, এ মানুষটি (প্রণব) আপনাদের জন্য বিশ্বে সমর্থন আদায় করতে ছুটে গিয়েছিলেন। সে সময় বঙ্গবন্ধুর মুখে ব্যক্তিগত স্তুতি শুনে কিছুটা লজ্জিত হয়েছিলাম।
সত্তরের দশকে আমরা দেখেছি, বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর নাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গোটা বিশ্বে নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কাছে আদর্শ। আমার মননে সব সময়েই এ দেশটি আলোড়িত করে। ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রথম বিদেশ সফর হবে বাংলাদেশ। জানি না, পারব কি-না। তবে আবার একবার বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছা রয়ে গেছে। এবার যাব সাধারণ নাগরিক হিসেবে। একজন বাঙালি হিসেবে। -সমকাল
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন