বন্ধ হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের ইউকে শাখা
অনিয়ম-দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে সোনালী ব্যাংকের যুক্তরাজ্য শাখার সব কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আবু ফরাহ মো. নাছের স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
১৯ অক্টোবর ইস্যু হওয়া ওই চিঠির কপি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব ইউনূসুর রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে। অন্যথায় সোনালী ব্যাংক ইউকে-এর কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে একজন বিদেশি প্রজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের পরামর্শ অবশ্য যুক্তরাজ্যের (ইউকে) প্রুডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটি আগে দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের উইন্ডিং ডাউন (বন্ধ) এর সিদ্ধান্ত যদি সরকারি পর্যায়ে গৃহীত না হয় তবে যুক্তরাজ্যের প্রুডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটির পরামর্শ অনুযায়ী একজন বিদেশি প্রকল্প ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিতে হবে। ওই প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানটির কার্যকম স্বাভাবিক করতে সম্ভাব্য পরিকল্পনা তৈরি করবেন। এতে সোনালী ব্যাংক ইউকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে যুক্তরাজ্যের প্রুডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটির এ পরামর্শ না শুনলে কার্যক্রম বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যথার্থ ভূমিকা নিয়েছে। সোনালী ব্যাংক দেশেও নানা অনিয়োমের সঙ্গে জড়িত। ইউকে নানান ধারনের অনিয়ম করেছে। সুতরাং এটিকে বন্ধ করে দেওয়াই উচিত। বিদেশি প্রকল্প ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেওয়ার বিরুদ্ধেও তিনি। এ ব্যাংকে বিদেশি প্রকল্প ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিয়ে কোনো লাভ হবে না বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সূত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক ইউকে-এর কার্যক্রম নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিব্রত। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কার্যক্রম বন্ধের বিকল্প হিসেবে একজন বিদেশি প্রজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগ করা যায় কি না-সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ দিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে বড় অঙ্কের জরিমানার পর এবার সোনালী ব্যাংক ইউকের ক্লিয়ারিং কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই ব্যাংকে বাংলাদেশি যেসব ব্যাংকের ‘নস্ট্রো’ অ্যাকাউন্ট ছিল তা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া শর্ত পালনে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স আহরণ ও ঋণপত্রের নিশ্চয়তা দিতে ২০০১ সালে আলাদা কোম্পানি খুলে যুক্তরাজ্যে যাত্রা শুরু করে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড। এর ছয়টি শাখা খোলা হলেও এরই মধ্যে চারটি বন্ধ হয়ে গেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছরের অক্টোবরে সোনালী ব্যাংক ইউকেকে ৩১ কোটি টাকা সমপরিমাণ প্রায় ৩৩ লাখ পাউন্ড জরিমানা করে যুক্তরাজ্যের ফিন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথরিটি (এফসিএ)। একই সঙ্গে ১৬৮ দিন নতুন গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
উদ্ভূত এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সোনালী ব্যাংক ইউকে পরিচালনা পর্ষদের জরুরি সভা করেছে। সোনালী ব্যাংক ইউকের পর্ষদ সদস্য হিসেবে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল-মাসুদ বর্তমানে যুক্তরাজ্য সফরে আছেন। তিনি দেশে ফেরার পর প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তা জানা যাবে।
নানা কারণে লোকসানে পড়ায় এবং নিয়ম মেনে মূলধন বৃদ্ধির প্রয়োজনে গত এপ্রিলে সোনালী ব্যাংক ইউকে সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা (৩ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড) জোগান পায়। এর মধ্যে মালিকানার ভিত্তিতে সরকার ১৭৮ কোটি এবং ব্যাংক দিয়েছে ১৭১ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক ইউকেতে সরকারের ৫১ ও সোনালী ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। কার্যক্রম পরিচালনার শুরুতে আড়াই কোটি পাউন্ড মূলধন জোগান দেওয়া হয়েছিল।
সংশ্নিষ্টরা জানান, রেমিট্যান্স আহরণের পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক ইউকে ‘নস্ট্রো’ অ্যাকাউন্ট খুলে ডলার, ইউরো ও ব্রিটিশ পাউন্ড- এই তিন ধরনের মুদ্রায় ক্লিয়ারিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারত। বাংলাদেশি অনেক ব্যাংক এসব মুদ্রায় ব্যাংকটিতে অ্যাকাউন্ট খুলে যুক্তরাজ্যে এলসিসহ বিভিন্ন দেনা পরিশোধ করে আসছিল। বিশেষত, এখানকার সরকারি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ দায় পরিশোধ হতো এই ব্যাংকের মাধ্যমে।
তবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সিদ্ধান্তের পর গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রথমে সাময়িকভাবে সব অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। পরে চূড়ান্তভাবে এসব অ্যাকাউন্ট বন্ধের বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো এখন বিকল্প চ্যানেল তথা এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, মাশরেক, সিটি ব্যাংক এনএ, আল-রাজী ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন ব্যাংকে খোলা নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে লেনদেন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কড়াকড়ি আরোপের পর শুধু গত বছরই বন্ধ করা হয়েছে তিনটি শাখা। এর মধ্যে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর বন্ধ করা হয় ব্র্যাডফোর্ড শাখা। এর আগে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর কেমডেন এবং ৩০ জুন লুটন শাখা বন্ধ করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বন্ধ করা হয়েছিল ওল্ডহ্যাম শাখা। মূলত ২০১৩ সালের জুনে এই শাখা থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার লুট করেন তৎকালীন ব্যবস্থাপক ইকবাল আহেমদ। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের লোকসানে পড়ে এই শাখাটি বন্ধ হয়। বর্তমানে চালু রয়েছে বার্মিংহাম ও লন্ডনের প্রধান শাখা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন