বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য, রুপিতে লেনদেন শুরু
ডলার সংকটকালে লেনদেন নিষ্পত্তির বিকল্প তৈরি চেষ্টায় দীর্ঘ আলোচনা শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে টাকা-রুপিতে লেনদেনের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ ও ভারত।
মঙ্গলবার ঢাকায় এ কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি শুরুর বিষয়টিকে একটি ‘বড় সূচনার প্রথম পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর বলেন, ‘বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ঝুড়িতে থাকা ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনবে রুপির লেনদেন। বড় কোনো যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ এটি। সামনের দিনে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে আরও বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে এ উদ্যোগ।’
গেলো পাঁচ বছরে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এগিয়েছে জোরেশোরে। ভারতের বাজার বড়, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি সম্ভাবনাময়। গেলো দুই বছরে দুই দেশে বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ নানা খাতে খরচ বেড়ে যাওয়ার পরও দুদেশে বাণিজ্য বেড়েছে, যা প্রথমবারের মতো দুই বিলিয়নের কাছাকাছি।
এরই ধারাবাহিকতায়, বিদেশী মুদ্রার নির্ভরতা কমাতে এজন্য দুই দেশ নিজ নিজ মুদ্রা বাণিজ্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শুরুতে যা হবে রুপীতে
এটা আমদানি-আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ডলারের চাপ কমাবে। লেনদেনে দ্রুতি বাড়াবে সাথে খরচ কমাবে ব্যবসায়ীদের।
ভারতীয় হাই-কমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, রুপিতে আমদানি-রপ্তানি শুরু হওয়ায় দুই দেশের বন্ধুত্ব ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে ‘নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন’ হল।
ভারতীয় হাই-কমিশনার বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম বাণিজ্যিক অংশীদার। রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি দুই দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করল। রুপিতে লেনদেন শুরু আমাদের ‘অংশীদারত্বের ভিত্তিতে উন্নয়ন ও অভিন্ন সংস্কৃতির ঘোষণার’ বিষয়টিই প্রমাণ করে।’
মঙ্গলবার ঢাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলে রুপিতে ভারত থেকে আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। বগুড়ার কোম্পানি তামিম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে এক কোটি ৬০ লাখ ভারতীয় রুপির পণ্য কেনার জন্য ভারতীয় আমদানিকারকের এলসি খোলার মধ্য দিয়ে হয় প্রথম লেনদেন।
স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ঢাকা শাখার মাধ্যমে এ রপ্তানি করা হয়। ভারতের আমদানিকারক ঋণপত্র (এলসি) খোলে দেশটির আইসিআইসিআই ব্যাংকের মাধ্যমে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রুপিতে প্রথম আমদানি করে নিটা কোম্পানি। এসবিআই ঢাকা শাখার মাধ্যমে তারা এক কোটি ২০ লাখ রুপির পণ্য আমদানির আদেশ দেয়। এসবিআই এর মুম্বাই শাখা পণ্য আমদানিতে ভারতে প্রতিনিধি ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে।
প্রথম আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি হিসেবে কোম্পানিগুলোর মালিকদের অনুষ্ঠানে দেওয়া হয় স্মারক উপহার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব শেখ মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ বলেন, ‘রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি হওয়ায় আমাদের ডলারের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় করলে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা আর হবে না। এটি শুধু লেনদেন নয়, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে আরো বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাংলাদেশ সব সময় ভারতকে ‘সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাণিজ্য অংশীদার ভারত।
তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে বিশাল যে বাণিজ্য ঘাটতি আছে, তা রুপি-টাকা বাণিজ্যের উদ্যোগে ভূমিকা রাখবে। এখন রুপি চালু হলেও পরে টাকায়ও বাণিজ্য শুরু হবে আশাকরি।
তিনি আরও বলেন, এ বাণিজ্যে ভারতের অংশ বেশি। ব্যবসার বাইরেও সেবাখাতের সম্প্রসারণে দুই দেশের জনগণ লাভবান হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
অর্থ সচিব বলেন, দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য ১২ দশমিক ৫ শতাংশ রুপিতে করা সম্ভব। এটি পুরোদমে চালু হলে টাকা-ডলার-রুপীতে যে মুদ্রা নষ্ট হয় সেটি কমবে।
এর ফলে উভয় দেশের উদ্যোক্তাদের বাণিজ্য খরচ কমে আসার পাশাপাশি ডলার নির্ভরতাও কিছুটা কমে আসবে বলে আশা করছেন ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আমরা রপ্তানি বহুমাত্রিক করার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উভয় দেশ নীতি সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।
আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, এতদিন যে বাণিজ্য হতো, তা আকুর মাধ্যমে হতো, যা রিজার্ভে চাপ বাড়াচ্ছে। করোনা পরবর্তী বিশ্বমন্দার যে চাপ তা আরও বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে এ চাপ কমাতে টাকা-রুপীর এ লেনদেন চালুর বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়েছে।
লেনদেন হবে যেভাবে
শুরুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ও আইসিআইসিআই ব্যাংক রুপিতে বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তিতে অংশ নিচ্ছে।
প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে রুপিতে লেনদেনের প্রক্রিয়া চালু করতে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনে ভারতের ব্যাংকগুলোতে রুপিতে ‘নস্ট্র অ্যাকাউন্ট’ (বিদেশের কোনো ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেন করতে খোলা হিসাব) খুলেছে সোনালী ব্যাংক ও ইবিএল।
এর ফলে, ডলারের মাধ্যমে এলসি বা ঋণপত্র খোলার প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি রুপিতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য ভারতের ব্যাংক দুইটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন আমদানিকারকরা।
একইভাবে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যাংক দুইটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন আমদানিকারকরা।
বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য ভারতে রপ্তানি করবে, তার বিপরীতে প্রাপ্ত রপ্তানি আয়ের সমপরিমাণ অর্থের পণ্য আমদানি করা যাবে রুপিতে।
টাকার বিপরীতে রুপিতে বিনিময় হার ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, যে হার ধরে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি খরচ নির্ধারণ করবে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে এক হাজার ৩৬৯ কোটি ডলার আমদানি দায় পরিশোধ করা হয়; যা মোট আমদানি ব্যয়ের ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয় ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন