বাড়ছে বানভাসির সংখ্যা, ছড়াচ্ছে পানিবাহিত রোগ
দেশের বন্যা পরিস্থিতি আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে ২৮ জেলা কমবেশি বন্যাকবলিত। এর মধ্যে কয়েকটি জেলা গত ২-৩ দিনে আক্রান্ত হয়েছে। অন্তত ২৫ জেলার মানুষ এক সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ ধরে বন্যার সঙ্গে লড়ছেন।
লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষের মাঝে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। অনেকের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। সহায়-সম্বল নিয়ে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্র, বাঁধ বা উঁচু স্থানে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। কেউ বা নৌকায় আশ্রয় নিয়ে দিনের পর দিন পানিতে ভাসছেন।
বন্যার্ত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরকারিভাবে বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে চার জেলায় আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ উত্তর-মধ্যাঞ্চলের আরও ২-৩টি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। বন্যার কারণে কারিগরি বোর্ডের অধীন ডিপ্লোমা-ইন-ফিশারিজ ও ডিপ্লোমা-ইন-লাইভস্টক প্রোগ্রামের আগামী ২১ থেকে ২৫ জুলাইয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বানের পানি এবং দেশের ভেতরের বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হয়েছে এই বন্যা। তবে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পানি নামছে।
কিন্তু আগামী এক সপ্তাহেও বন্যা পরিস্থিতি থেকে পুরোপুরি মুক্তির কোনো আশা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। বরং বাংলাদেশ-ভারতের আবহাওয়া সংস্থাগুলো ২১ জুলাই থেকে ফের ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতি উত্তরণে ধীরগতির আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
এবারের বন্যার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হল নদ-নদীতে রেকর্ড পরিমাণ পানির প্রবাহ। যমুনা নদী জামালপুরের বাহাদুরাবাদে ইতিহাসের সর্বাধিক পানি বহন করে। একই অবস্থা ছিল নীলফামারীতে তিস্তা এবং বান্দরবানে সাঙ্গু নদীতে। অতীতে কখনই এই তিন নদীর পানি এত ওপরে ওঠেনি।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বাহাদুরাবাদ পয়েন্টের পর যমুনার পানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হতো। কিন্তু পলি পড়ে প্রধান চ্যানেল ধীরে ধীরে বামদিকে সরে গেছে। একটি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে প্রত্যাশিত মাত্রায় পানি নামতে পারেনি।
তিনি বলেন, উজান থেকে যে বৃষ্টির পানি বেশি এসেছে তা নয়। ১৯৮৮ সালে এই পয়েন্ট দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ২ হাজার কিউসেক পানি নামত, সেখানে এবার নেমেছে মাত্রা ৬৫ হাজার কিউসেক। ফলে বাকি পানি নামতে না পেরে জমা হয়েছে। এতে একদিকে অল্প পানি এলেও তা রেকর্ড ভেঙেছে।
শুক্রবার (১৯ জুলাই) পর্যন্ত বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে আছে- কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার।
এছাড়া চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, জেলায় বন্যায় আক্রান্ত। ঢাকার ডেমরা, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বিপদসীমার কাছে অবস্থান করছে।
এছাড়া শেরপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও শরীয়তপুরে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্যার পানি পৌঁছে যাবে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান শুক্রবার (১৯ জুলাই) বলেন, ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টির প্রবণতা কমে এসেছে।
এ কারণে পানি না বেড়ে কমার প্রবণতা শুরু হবে। বগুড়া, কুড়িগাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে জামালপুরের একটি অংশ, পদ্মার কারণে শরীয়তপুরের মানুষও বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে আগামী ২৪ ঘণ্টায়। চাঁদপুর, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় বন্যার পানির চাপ বাড়বে।
শুক্রবার (১৯ জুলাই) এফএফডব্লিউসি’র দেয়া বুলেটিনে বলা হয়, ১৪ নদ-নদীর পানি ২২ স্টেশনে বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হয়েছে। তবে বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত নদী ও স্টেশনের সংখ্যা আরও বেশি বলে জানা গেছে।
এফএফডব্লিউসি বলছে, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন সুরমা, সোমেশ্বরী, তিতাস, মেঘনা, ধরলা, ঘাগট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, আত্রাই, ধলেশ্বরী ও পদ্মা বিপদসীমার ওপরে আছে। কংস, গুর, বাঙালি, ছোট যমুনা পুরাতন ব্রহ্মপুত্রও বিপদসীমার ওপরে আছে বলে জানা গেছে।
নওগাঁয়ে যমুনা নদীর বেরিবাঁধ ভেঙ্গে ৩ গ্রাম প্লাবিত : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে শুক্রবার ভোর রাতে নওগাঁর রাণীনগরের মালঞ্চি গ্রামের ছোট যমুনা নদীর অভিভাবকহীন প্রায় ৫০হাত বেরিবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এতে করে ৩টি গ্রাম নতুন করে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। চরম বিপাকে পড়েছে এই এলাকার বানভাসী মানুষরা।
পানিতে তলিয়ে গেছে কয়েকশত পুকুর, আমন ধান ও শতাধিক হেক্টর সবজির আবাদ। তবে ছোট যমুনা নদীতে পানির গতিবেগ কম থাকায় পানিতে প্লাবিত এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি কম হবে বলে ধারনা করছেন এলাকাবাসী।
অপরদিকে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও একটানা লাগাতার বর্ষণের ফলে নওগাঁর আত্রাইয়ের ছোট যমুনার পানি যেমন বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নওগাঁ-আত্রাই আঞ্চলিক সড়কের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দেয়ায় বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কে রয়েছে এলাকাবাসী। এখন প্রতিটি মুহুর্তে উপজেলার প্রতিটি মানুষের মাঝে বিরাজ করছে বাঁধ ভাঙ্গার আতঙ্ক। এমন আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন কাটছে উপজেহলার কয়েকটি গ্রামের লাখ লাখ মানুষ।
গোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত খাঁন হাসান বলেন আমার এলাকার ছোট যমুনা নদীর নান্দাইবাড়ি,মালঞ্চি,কৃষ্ণপুর ও আত্রাই উপজেলার ফুলবাড়ি বেরিবাঁধটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে অভিভাবকহীন। কোন দপ্তর কোনদিন এই বাঁধটি সংস্কার করেনি। এমনকি এই বাঁধটিকে কোন দপ্তরই স্বীকার করে না যার কারণে সংস্কার ও উন্নয়নের কোন প্রকারের ছোঁয়া এই বাঁধে কখনো স্পর্শ করেনি। যার ফলশ্রুতিতে বাঁধটি দীর্ঘদিন যাবত চরম ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় ছিলো। আজ বাঁধটির মালঞ্চি এলাকার কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে।
এতে করে নদীর তীরবর্তি কয়েকটি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে। শুধু বাড়ি-ঘরই নয় এই এলাকা পুকুর ও সবজির আবাদের জন্য বিখ্যাত। আশঙ্কা করা হচ্ছে এই বন্যার কারণে এই এলাকা কয়েকশত পুকুর ও শতাধিক হেক্টরের সবজির আবাদ পানিতে তলিয়ে যাবে। এছাড়াও নওগাঁ-আত্রাই সড়কের বেশকিছু জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেইসব ঝুঁকিপূর্ন স্থান স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তায় স্থানীয়রা রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শহীদুল ইসলাম বলেন ভেঙ্গে যাওয়া অংশে নদীর পানিতে তেমন গতি না থাকায় বন্যাকবলিত এলাকা ছাড়া অন্যান্য ফসলের তেমন উল্লেখ্যযোগ্য ক্ষতি হবে না বলে ধারনা করা হচ্ছে। তবে প্লাবিত ৩টি গ্রামের সবজির আবাদ ও পুকুর বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। কৃষি অফিসের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে বন্যা কবলিত এলাকায় সার্বক্ষণিক থাকার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মামুন বলেন আমরা ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সংখ্যা ও ক্ষতির পরিমাণ নিরুপন করে তাদের জন্য সহায়তা হিসেবে ত্রান সামগ্রী বিতরন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এছাড়াও ভেঙ্গে যাওয়া অংশ বাঁধার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের উর্দ্ধতন কর্মর্কতারা বাঁধটি পরিদর্শন করে পরবর্তি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
আত্রাইয়ে এখনও পর্যন্ত যেভাবে নদীর পানি বাড়ছে তাতে যে কোন মুহুর্তে উপজেলার রসুলপুর, মির্জাপুর, মদনডাঙ্গা, পাঁচুপুর, মধুগুরনইসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভাঙ্গার আশঙ্কা করছে উপজেলার সচেতন মহল। বাঁধ রক্ষায় নদী পারের গ্রামগুলোর শত শত মানুষ অনিদ্রায় রাত কাটাচ্ছেন। এদিকে বাঁধ গুলোকে রক্ষা করা না গেলে উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে বলেও মনেকরছেন তারা।
উপজেলাবাসীর অভিযোগ যেহেতু প্রতি বছরই আমাদের উপজেলায় বন্যায় শত শত ঘরবাড়ি, হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমির ফসল, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। পানি বন্দি হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। বছরের পর বছর অতিবাহিত হলেও কর্তৃপক্ষ উপজেলার বেঁড়িবাধ গুলো সংস্কার করে না। বাঁধগুলো সংস্কার করলে আজ হয়তো বাঁধ ভাঙ্গার অতঙ্কে নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হতো না এমনটিই অভিযোগ তাদের।
ইতোমধ্যে আত্রাই ছোট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে উপজেলার ফুলবাড়ি, রাইপুর, মিরাপুর, উদনপৈয়, পশ্চিম মিরাপুর, জাতোপাড়া, রসুলপুরসহ বেশ কয়েকটা গ্রামের শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বিশেষ করে বন্যাদুর্গত পরিবার গুলো গবাদী প্রাণি ও শিশু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন। তাদের এখন বিশুদ্ধ খাবার পানি, জরুরী মেডিসিন এবং গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে ফুলবাড়ী গ্রামের খন্দকার জিতু আহম্মেদ জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও একটানা লাগাতার বর্ষণের ফলে নওগাঁর আত্রাইয়ের ছোট যমুনার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় আমাদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোর শতশত পরিবার পনিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। কোমলমতি শিশুরা স্কুলেও যেতে পারছেনা।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছানাইল ইসলাম জানান, আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতিটি এলাকায় মাইকিং ও মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। আতঙ্কের কোন কারণ নেই উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ উপজেলা প্রসাশন তদারকি করছে। এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ টিকিয়ে রাখতে সকল প্রকার প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে নওগাঁ পানি উন্নয়ন বর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। এমনকি পুরো বাঁধ সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। বালুর বস্তা এবং জিওব্যাগ দিয়ে পানি চোয়ানো বন্ধে কাজ করা হচ্ছে।
টাঙ্গাইল : পানির তীব্র স্রোতে ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত নলীন-পিংনা-যোকারচর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বৃহস্পতিবার রাতে ভেঙে গেছে। বাঁধ মেরামতের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বাঁধ ভেঙে ভূঞাপুর পৌরসভা ও ফলদা ইউনিয়নের ৭/৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভূঞাপুরের সঙ্গে তারাকান্দির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি কমতে শুরু করলেও নতুন করে কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সাদুল্যাপুর, পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় এখন গাইবান্ধার সাত উপজেলাই বন্যাকবলিত।
শুক্রবার বন্যার পানিতে ডুবে গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জ সুগার মিল এলাকায় মনু মিয়ার মেয়ে মুন্নি (৭) ও বৃহস্পতিবার বিকালে সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের জাহেদুল ইসলামের মেয়ে জান্নাতী খাতুন (১০) মারা গেছে। ৩৬৩টি গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নতুন করে ১৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উঁচু সড়ক ও আশ্রয় কেন্দ্রে বানভাসি মানুষ প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন।
কুড়িগ্রাম ও উলিপুর : জেলায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দুর্ভোগ। এখনও ঘরে ফিরতে পরছেন না দুর্গতরা। এছাড়া অপ্রতুল ত্রাণের কারণে বিভিন্ন স্থানে হাহাকার দেখা দিয়েছে। শুক্রবার সকালে পানিতে পড়ে সীমা খাতুন নামে দেড় বছরের একটি শিশু মারা গেছে। সে উলিপুর পৌরসভার খাওনারদরগা গ্রামের ভাটিয়াপাড়ার সাদেক মিয়ার মেয়ে।
লালমনিরহাট : বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছে জেলা পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাত অবধি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রত্যেককে ৫ কেজি চাল, ২ লিটার বিশুদ্ধ পানি, আধা কেজি মুড়ি ও ৫ প্যাকেট করে বিস্কুট দেয়া হয়।
শেরপুর ও শ্রীবরদী : শেরপুর-জামালপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পোড়ার দোকান কজওয়ের (ডাইভারশন) ওপর দিয়ে প্রবলবেগে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় শেরপুর থেকে জামালপুর হয়ে রাজধানী ঢাকা ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ শুক্রবার সকাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শেরপুর সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কাঁচা ঘর-বাড়ি, গ্রামীণ রাস্তাঘাট, রোপা আমন ধানের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
সিরাজগঞ্জ : জেলার ৫টি উপজেলার ৩৬টি ইউনিয়নের ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। যমুনাসহ অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে পানি কমতে শুরু করলেও বাঙালিতে বাড়ছে। শুক্রবার বিকাল ৬টায় যমুনার পানি ৫ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাঙালি নদীতে পানি ১২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমা স্পর্শ করেছে। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় প্রায় ৮২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।
মানিকগঞ্জ : দৌলতপুর উপজেলার বাচামারা ইউনিয়নের প্রায় দু’শ বসতববাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও মাদারগঞ্জ (জামালপুর) : পানি বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে ভাঙন। ১ সপ্তাহে চিকাজানীর খোলাবাড়ীর চর উচ্চ বিদ্যালয়, খোলাবাড়ী গুচ্ছগ্রামের ১৫০টি পরিবারের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
জুড়ী (মৌলভীবাজার) : শুক্রবার বিকাল ৫টায় জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।
কমলগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, এখনও পৌঁছায়নি ত্রাণ : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের শমশেরনগর, পতন উষার ও মুন্সীবাজার এলাকায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। হতদরিদ্র পানিবন্দি শত শত পরিবারের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোন ত্রাণ পৌঁছায়নি। ৫২ টন চাল বরাদ্দ হলেও বুধবার থেকে সেগুলো বিতরণ করা হবে বলে জানা গেছে। শুকনো খাবার না থাকায় অনেক পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। নদী ভাঙ্গন ও ঢলে গত শুক্রবার রাত থেকে পানিবন্দি হতে থাকে এসব পরিবার।
কমলগঞ্জের পতনঊষার ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নন্দ্রগ্রাম, কোনাগাঁও, নিজ বৃন্দাবনপুর, গোপীনগর, রাধাগোবিন্দপুর, মাজগাঁও, বাজারকোণা, কোনাগাঁও, পশ্চিম পতনঊষার, ফরিংগাকোণা প্রভৃতি গ্রামে এখনো মানুষের বসতবাড়িতে পানি রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি ত্রাণ সহায়তা আসেনি তাদের।
পতনঊষারের কৃষক তোয়াবুর রহমান বলেন, ‘আমরা ত্রাণ চাই না। বীজ, হালির চারাসহ জরুরি ভিত্তিতে কৃষি পূণর্বাসন চাই।’ বাজারকোণা গ্রামের রিক্সাচালক ও হোসেন মিয়া জানান, ‘গত ৫দিন ধরে এ গ্রামের ৩৫টি পরিবার পানিবন্দি। ঘরের চুলা পর্যন্ত জলছে না। এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ আসেনি।’
পতনঊষার ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড সদস্য আং কুদ্দুস জানান, ‘তার ওয়ার্ডে ৬টি গ্রামের প্রায় ৪০০ পরিবার এখনো পানিবন্দি। অনেক লোক বসতঘর ছেড়ে গরু-ছাগল, মালামালসহ বাহিরে আশ্রয় নিয়েছে। এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জলেরও সংকট দেখা দিয়েছে।’
এছাড়া উপজেলার শমশেরনগর, পতনউষার, মুন্সীবাজার ও রহিমপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল এলাকার প্রায় ৩৫টি গ্রামের ৭০০ পরিবার গত চারদিন ধরে বন্যার পানি মোকাবেলা করে দিন কাটাচ্ছে। চারদিনেও সরকারি কোনো ধরণের ত্রাণ না আসায় হত দরিদ্র পরিবার সদস্যরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ গবাদিপশু নিয়েও একই ঘরে দিন যাপন করছেন। এসব পরিবার সদস্যদের শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সংকট দেখা গেছে।
শমশেরনগর ইউপি চেয়ারম্যান জুয়েল আহমদ ব্যক্তিগতভাবে ২০০ পরিবারের মধ্যে ৫ কেজি চাল, হাফ লিটার সোয়াবিন, এক কেজি পিয়াজ, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি চিরা ও ১ কেজি আলু বিতরণ করেন।
চরভদ্রাসন (ফরিদপুর) : চরভদ্রাসন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উপজেলার চর ঝাউকান্দা ইউনিয়ন, চরহরিরামপুর ইউনিয়ন ও গাজীরটেক ইউনিয়নসহ সদর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
জগন্নাথপুর : শুক্রবার বন্যার পানি কিছুটা কমলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, বন্যায় এ পর্যন্ত ১১০০ হেক্টর আমন ধানের বীজতলা তলিয়ে গেছে। এছাড়া ৮০০ হেক্টর আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে।
জামালপুরে সাপের কামড়ে মৃত্যু, পানিতেই জানাযা : বন্যার পানিতে সাপের ছোবেলে মৃত্যু হয়েছে দেওয়ানগঞ্জের সানন্দবাড়ী পশ্চিমপাড়ায় বাবলাতলীর মজিবুর রহমানের (৭০)।
তার জানাযার নামাজ পড়াতে কোনো শুকনা জায়গা পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়েই পানিতেই জানাযা পড়তে হয় মুসল্লিদের। ১৮ ই জুলাই সন্ধ্যায় সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় মজিবুর রহমানের।
সারা এলাকায় শুকনা জায়গা না পাওয়ায় বাধ্য হয়েই আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় জানাযা পড়ানো হয় হাটু সমান পানির মধ্যেই।
স্থানীয়রা জানায়, সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ পরেই নিজ ঘরে সাপের কামড়ে আহত হয় মজিবর। পরে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
বাড়ছে বানভাসির সংখ্যা, ছড়াচ্ছে পানিবাহিত রোগ : প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ায় বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে বাড়ছে বানভাসির সংখ্যা। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। অনেক স্থানে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, ফসল ও পুকুরের মাছ। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন বন্যাদুর্গতরা। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে কলেরা, ডায়রিয়াসহ ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ।
বন্যার পানির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে বসতবাড়ি। বুধবার রাতে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের তাড়াই এলাকায় বাঁধ ভেঙে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরও ১০টি গ্রাম। পানিবন্দি ১১১ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ। পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে মানবেতর দিন যাপন করছেন তারা।
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বেড়ে ৯ উপজেলার ৬ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছেন। বেশিরভাগ বসতবাড়ি ডুবে গেছে। ঘরহারা মানুষ গবাদি পশু নিয়ে বাঁধ, রাস্তাঘাট, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নিয়েছেন। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে কলেরা, ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ১৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ ও মেলান্দ উপজেলাসহ ৬ উপজেলার ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ৩ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তলিয়ে গেছে ১৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল। রেল লাইনে পানি উঠে যাওয়ায় ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে।
বগুড়ার সারয়িাকান্দি, সোনাতলা, ধুনটে বন্যার পানি বেড়ে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও পুকুরের মাছ। লাখো মানুষ নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বানভাসি মানুষের কাছে এখনো পৌঁছায়নি ত্রাণ সহায়তা।
সিরাজগঞ্জের ৫ উপজেলার নিচু ও চর এলাকা ডুবে যাওয়ায় মানুষ বাঁধের উঁচু স্থানে অবস্থান নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ২০৫ মেট্রিকটন জাল ও দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
শরীয়তপুরে পদ্মার পানি বেড়ে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে নড়িয়া উপজেলার ঘরিষার ও নশাশন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম। তলিয়ে গেছে মোক্তারচরের বেশিরভাগ রাস্তাঘাট।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন