বিটকয়েন আসলে কী?
ব্যবসায়িক কাজে ভার্চুয়াল মুদ্রা বিটকয়েনকে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বৈধতা দিয়েছে মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাদর। অতিসম্প্রতি দেশটির জাতীয় পরিষদে এক ভোটাভুটিতে এই বৈধতা দেওয়া হয়। তবে বিটকয়েনকে বৈধতা দেওয়ায় দেশটিতে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, ডিজিটাল এই মুদ্রার দাম ৯ শতাংশ বেড়ে ৪৭ হাজার ৮০০ ডলারে পৌঁছেছে।
এর আগে, চীন সরকার এ মুদ্রার ওর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বিটকয়েনসহ সব ডিজিটাল মুদ্রার দরপতন হয়। তবে সর্বশেষ গত শুক্রবার ভেনেজুয়েলা সরকার এই মুদ্রাকে বৈধতা দিলে এর দামের পালে হাওয়া লাগে। সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের পক্ষ থেকে যখন বলা হলো, তারা এই মুদ্রার ওপর কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবছে না, তখন তরতর করে এর দাম বাড়তে থাকে।
এদিকে, ভেনেজুয়েলা ও তাজিকিস্তানের মতো কিছু দেশের দরজা একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে বিটকয়েনের জন্য। বৈধতা পাচ্ছে। অনেক দেশের সরকারই বৈধতা দেওয়ার কথা ভাবছে। নাইজেরিয়াসহ বেশ কিছু দেশ নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলনের কথা ভাবছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দেশে দেশে এই বৈধতা পাওয়ার বিষয়টিই বিটকয়েনসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মুদ্রার দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে কাজ করছে।
বিটকয়েন কী, কেন, কীভাবে?
বিটকয়েন টাকা পয়সার মতোই একটি মুদ্রা। তবে এটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল মুদ্রা। এটা একটি বিকেন্দ্রীকৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বাণিজ্যিক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর থেকে এটা একদম পৃথক এক ব্যবস্থা। পৃথিবীজুড়ে একই শর্তে বিটকয়েন বিনিময় করতে হয়। এই কয়েন ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রটোকলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ব্যবহারকারীর পরিচয় ও ক্রিয়াকলাপ গোপনের জন্য ব্যবহার করা হয় এনক্রিপশন।
ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের জন্ম ২০০৮ সালে। ওই বছরের শেষভাগে জাপানি নাগরিক সাতোশি নাকামোতো নামের একজন বা একদল সফটওয়্যার প্রকৌশলী এই ক্রিপ্টোকারেন্সি উদ্ভাবন করেন। ২০০৮ সালে এর নকশা হলেও এটি মুক্ত সোর্স সফটওয়্যার হিসেবে প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে।
বিটকয়েন ধরে রাখার তিনটি ভিন্ন পদ্ধতি আছে। প্রথমত, আপনি কয়েনবেস বা বিটফিন্যান্সের মতো অনলাইন এক্সচেঞ্জগুলোতে আইনি দরপত্র দিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আপনি আপনার পণ্য ও পরিষেবা বিনিময়ের মাধ্যমে বিটকয়েন রাখতে পারবেন। তৃতীয়ত, প্রক্রিয়াকরণ (মাইনিং) করে আপনি নিজে বিটকয়েন তৈরি করতে পারেন। বিটকয়েন তৈরি করতে খনি শ্রমিকের মতো পরিশ্রম করতে হয়। মেধা তো আছেই, প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তিরও প্রয়োজন।
টাকা-পয়সা রাখতে যেমন আমরা মানিব্যাগ বা ওয়ালেট ব্যবহার করি, তেমনি বিটকয়েন রাখতে দরকার ডিজিটাল ওয়ালেট বা মানিব্যাগ। ডিজিটাল মানিব্যাগ ছাড়া কোনো বিটকয়েন রাখা যায় না। আপনাকে বিটকয়েন কেনার আগে কম্পিউটারে তথাকথিত ওয়ালেট বা মানিব্যাগ সফটওয়্যার ইনস্টল করতে হবে। এই মানিব্যাগে একটি সর্বজনীন বা ব্যক্তিগত চাবি দেওয়া থাকে, যা ব্যবহারকারীকে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের অনুমোদন দেয়। স্মার্টফোন, ইউএসবি স্টিক বা অন্য কোনো ডিজিটাল হার্ডওয়্যার বা ক্লাউডভিত্তিক ডেটা স্টোরেজও মানিব্যাগ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিজিটাল মানিব্যাগ ছাড়া আপনার জন্য কোনো বিটকয়েন দেওয়া হবে না।
বিটকয়েনের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ের প্রক্রিয়াও অনেকটা সহজ। ধরুন, জনাব এক্স-এর একটি টুপি দরকার। আর টুপিটি বিক্রি করবেন জনাব ওয়াই। তাহলে প্রথমে জনাব এক্সকে তার মানিব্যাগের ঠিকানা দিতে হবে। অর্থাৎ, এটি একটি ব্যাংকের মতো। এক্স তখন ওয়াইয়ের ঠিকানা পাওয়ার পর সত্যি তিনি ডিজিটাল মুদ্রার প্রেরক কিনা, তা যাচাই করে ব্যক্তিগত চাবি দিয়ে সই করে দেবেন। প্রতিদিন এমন হাজার হাজার বিটকয়েন লেনদেন একটি ব্লকচেইনে সংরক্ষণ করা হয়।
এরপর এক্সের লেনদেনটি পিয়ার টু পিয়ারের মাধ্যমে সমস্ত অংশগ্রহণকারীকে জানানো হয়, যাকে নোডও বলা হয়। তারা ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা মাইনারের মাধ্যমে লেনদেনের বৈধতা যাচাই করে। এর পর সেই বিটকয়েন পাঠানো হবে ওয়াইয়ের মানিব্যাগে। এরপরই তিনি ব্যক্তিগত চাবি দিয়ে তা আনলক করতে পারবেন।
তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রত্যেক লেনদেনকারী ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে ‘মাইনার’ হতে পারেন। তবে বেশির ভাগ সময় এই কাজগুলো বড় কম্পিউটার প্রতিষ্ঠানে করা হয়, যাদের অনেক বেশি শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে।
এই যে লেনদেন, এর তথ্য বা ডেটা হবে অপরিবর্তনীয়। এক্স ও ওয়াইয়ের মধ্যে বিটকয়েন লেনদেন একটি বিশাল পাবলিক লেজার বা ব্লকচেইনে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রতিটি ব্লক সিস্টেমে কেউ প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ব্যবহারকারীর প্রতিটি লেনদেন সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে দেওয়া হয়। কাকে কয়টি বিটকয়েন পাঠানো হয়েছে, তাও জানিয়ে দেওয়া হয়। কোনও লেনদেন পরিবর্তন করা যাবে না।
বিটকয়েনে কিছু বিতর্ক থেকেই যায়। মাইনাররা লেনদেনের প্রক্রিয়া করার সময় নতুন বিটকয়েন তৈরি করে, যেখানে তারা বিশেষ ডিক্রিপশন সফটওয়্যার ব্যবহার করে। এই প্রক্রিয়া একবার সম্পন্ন হলে চেইনে একটি নতুন ব্লক যুক্ত হয় এবং মাইনারকে বিটকয়েন দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। বিটকয়েন নেটওয়ার্কের বড় মাইনার হচ্ছে চীন। কয়লা থেকে সস্তা বিদ্যুৎই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রেখেছে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া ইত্যাদি। কিন্তু এখন এই চীনই বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন নিষিদ্ধ করল।
বিটকয়েনের জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন। ক্রিপ্টোমাইনিং ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য বৃহদাকার কম্পিউটিং পাওয়ারের প্রয়োজন হয়। তাই বিটকয়েন নেটওয়ার্ক বিপুল পরিমাণে শক্তি ব্যয় করে। প্রতি বছর ১২০ টেরাওয়াট ঘণ্টা শক্তি গ্রহণ করে। ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের বিটকয়েন ইলেকট্রিসিটি কনজাম্পশন ইনডেক্সে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সে যাক। এত ঝুঁকি সত্ত্বেও বহু দেশ তো বিটকয়েনসহ ডিজিটাল মুদ্রায় এখন আস্থা পাচ্ছে। বাংলাদেশেরও এ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা বদলের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে যারা এই বিটকয়েন নিয়ে মশগুল, বিশেষত যারা খনি থেকে মুদ্রা তুলে আনার স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা প্রস্তুতি নিতেই পারেন। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজ দেশের প্রশাসন এই লেনদেন ও মাইনিংকে সমর্থন করে কিনা, তা জেনে নিন।
সূত্র : রানার মিডিয়া টোয়েন্টিফোর।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন