বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে কেন এত অভিযোগ?
শাহান তৌফিক পৃথিবীর বুকে বেঁচে ছিল এক মাস ১৯ দিন। নির্ধারিত সময়ের আট সপ্তাহ আগে জন্ম। জন্মের পর রাখা হয়েছিল ইনকিউবেটরে। এরপর সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠছিল শিশুটি। কিন্তু হঠাৎ জানা গেল ইনকিউবেটরে থাকা প্রিম্যাচিওর শিশুদের চোখে সমস্যা হতে পারে, এমনকি অন্ধত্বের ঝুঁকিও রয়েছে। তখন তার চোখে লেজার দিয়ে একধরনের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। তৃতীয় দফায় সেই চিকিৎসা নিতে গিয়েই চিকিৎসকের ভুলে মারা গেল শিশুটি।
তার বাবা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘ওকে যখন লেজার করতে যায় ও বমি করে ফেলে। এক হাতে ওকে চেপে ধরে রাখে আর আরেক হাতে লেজার করে। ও চিৎকার করছিল আর বমি করছিল। ওই বমি শ্বাসনালীতে আটকে যায়। বমি করা অবস্থায় তাকে লেজার করছিল। চিন্তা করুন কী কষ্ট পেয়ে আমার বাচ্চাটা মারা গেছে।’
তিনি বলছিলেন, ‘সেখানে চিকিৎসকদের কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছিল না। কোনো বাচ্চাকে লেজার করতে চাইলে পিডিয়াট্রিক চিকিৎসকের উপস্থিতি লাগে। সাকশান মেশিন থাকতে হয়, ইনকিউবেটর থাকতে হয়। ওকে যখন থার্ড টাইম ফলো আপে লেজার করছিলো তখন সাপোর্টিং কিছু ছিল না।’
অবহেলা, ভুল চিকিৎসা
বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশে রোগীদের অভিযোগের সীমা নেই। বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী মোহাম্মদ হোসেন খান মাসদুয়েক আগে একটি অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। নাভিতে ইনফেকশন হয়েছিল।
খুব ব্যথা নিয়ে যখন চিকিৎসার জন্য ছুটোছুটি করছেন তখন তাকে তিনজন চিকিৎসক তিন ধরনের খরচের কথা বলেছেন। কিছুটা ভয় থেকেই এদের মধ্যে সবচাইতে নামি চিকিৎসককেই বেছে নিয়েছিলেন মোহাম্মদ হোসেন।
তিনি বলছেন, ‘তিনজনের মধ্যে ধানমন্ডির যে ক্লিনিকে গেলাম ওরা পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইলো। অন্য একটা ক্লিনিকে এর অর্ধেক চেয়েছিল।’
‘আমি ধানমন্ডিতেই গিয়েছিলাম কারণ ওরা বলল তাদের সার্জন এ ক্যাটাগরির। অপারেশনের ২০ দিন পর আমার ওই যায়গায় আবার পেইন শুরু হয়।’
‘পরে দুইবার ডাক্তারের কাছে যাবার পরে ডাক্তার দেখেন যে আমার ওখানে একটা সুতা রয়ে গেছে। যেখানে আমার ১৫ দিনের মধ্যে সুস্থ হওয়ার কথা সেখানে দেড় মাস সময় লেগেছে। এই কারণে আমার ব্যক্তিগত ও প্রফেশনাল জীবনে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তারমানে বেশি টাকাও দিলেন কিন্তু ভোগান্তিও বেশি হলো।’
জরুরি চিকিৎসায় অনীহা
সরকারি তথ্যমতে বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দশ হাজার ছয়শোর মতো। এসব প্রতিষ্ঠানে ভুল চিকিৎসা, অবহেলা, সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা ছাড়াও প্রচুর অর্থ নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন সেবার জন্য নির্ধারিত ও সমন্বিত কোনো মূল্য তালিকা নেই। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে ইমার্জেন্সি বলে সাইনবোর্ড টাঙানো থাকলেও সেখানে আসলে জরুরি চিকিৎসা মেলে না।
রোগীদের জরুরি সেবা দিতে অস্বীকৃতির কারণে রোগীর মৃত্যুর উদাহরণ বাংলাদেশে প্রচুর রয়েছে, বিশেষ করে দুর্ঘটনা, নির্যাতন ও আত্মহত্যার ঘটনার ক্ষেত্রে। বিষয়টি নিয়ে ক্যাম্পেইন করছেন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ইমারজেন্সি মেডিসিন নামে একটি সংস্থার মহাসচিব ডা. রাঘীব মানজুর।
তিনি বলছেন, ‘আমার মনে হয় ইমার্জেন্সি বিভাগ রাখার ব্যাপারে তাদের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। ভীতিটা এই যে তাদের দক্ষতার অভাব। যেহেতু বাংলাদেশে ইমার্জেন্সি চিকিৎসা নিয়ে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন নাই তাই এটা নিয়ে চর্চা হচ্ছে না। বিভিন্ন হাসপাতালে ইমার্জেন্সিগুলোতে যাদের থাকার কথা সেখানে ভ্যাকান্সি আছে।’
তিনি বলছিলেন, দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত কেউ বা অন্য কিছু ক্ষেত্রে রোগী ভর্তি না করে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়ার প্রবণতার পেছনে কারণ হলো আরেক ধরনের ভয়। তার মতে, ‘ইমার্জেন্সিতে একটা ট্রমার পেশেন্ট নিলে সেনিয়ে পরে যখন কোনো মামলা হবে তখন মামলায় সাক্ষী দেবার জন্য বারবার কোর্টে দৌড়াতে হবে কি না সেটা তাদের মধ্যে কাজ করে।’
মুনাফা বনাম সেবা
তবে আরেকটি বিষয় তিনি উল্লেখ করলেন। তা হলো মুনাফা। তার মতে, ‘ইমার্জেন্সি চিকিৎসা কোনো লাভজনক জায়গা না। এখানে হয়ত প্রফিট হয় না। এটা সম্ভবত আরেকটা কারণ।’
সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ বছরে বেসরকারি খাত থেকে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে থাকেন। সেবার বদলে মুনাফার দিকেই যেন তাদের নজর বেশি।
অল্প খরচে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া গেলেও তার সংখ্যা অনেক কম। তাই যেতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল। তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকস ওনার্স এসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. মইনুল আহসান বলেন, ‘সবাই টাকা আর্ন করতে চায়। তারা এটাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে একেকরকম চার্জ।’
‘বড় বড় নামকরা হাসপাতাল বাদ দিলেও অন্যান্যগুলোতেও চার্জ অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা ডাক্তার হয়েছি মানুষের সেবা করা জন্য। কোনো সন্দেহ নেই, সেটি খুবই কঠিন কাজ।’
তবে তিনি বলছেন, আশপাশের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডাক্তারদের ফি এখনো অনেক কম। সেক্ষেত্রে তিনি থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করেছেন।
বাংলাদেশ বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখনো চলছে ১৯৮২ সালে করা একটি অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী। সেই আইনে নির্দিষ্ট মূল্য তালিকা বা জরুরি বিভাগ করার বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলছেন, নতুন আইনসহ বেশ কিছু পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। তিনি বলছেন, ‘এসব ক্ষেত্রে আগের মতো অব্যবস্থা আর সহ্য করা হবে না। আমরা পরিদর্শন ও তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করছি, একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রাইসিং ঠিক করবো যাতে করে তার থেকে বেশি কেউ না নেন।’
তিনি হাসপাতালগুলোর নিজেদের মধ্যেও পরিদর্শন ও তদারকি বাড়ানোর কথা বলছেন। এছাড়া চিকিৎসা প্রদানকারী ও সেবাগ্রহীতার জন্য একটি সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সেরকম সুরক্ষার অভাবে হয়ত প্রাণ হারিয়েছে অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলামের ছোট শিশুটি। তিনি বলছিলেন, অবহেলার জন্য দায়ী চিকিৎসক তার সহকর্মীদের নিয়ে শিশুটির জানাজার দিন তার গ্রাম পর্যন্ত গিয়েছিলেন মামলা ঠেকাতে। তিনি তার ভুলের কথা স্বীকারও করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ডাক্তারি রিপোর্টেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে।
মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম কোনো ক্ষতিপূরণও নিতে চাননি। তিনি বলছিলেন, ‘হাসপাতালে ওকে মৃত ঘোষণা করার পর আমি আমার স্ত্রী, ভাইবোনসহ যখন বসে কান্নাকাটি করছিলাম তখন সে (চিকিৎসক) আমার পা ধরে মাফ চাইতে আসছিল। সে আমাকে বলেছিল আমি সরি। তখন আমি তাকে বলেছিলাম সরি ফর হোয়াট?’ –বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন