চাপে থাকবে ব্যাংক খাত
বড় বাজেটে বিশাল ঘাটতি
চলতি বছর শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সেই হিসাবে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটই বর্তমান সরকারের দায়িত্বকালের শেষ বাজেট। নির্বাচনে ভোট টানতে একগুচ্ছ বড় প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা হচ্ছে। সরকারের শেষ সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তি, সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবি পূরণ করতেও প্রয়োজন হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
সবকিছু সামাল দিতে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা বাজেট প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিশাল ব্যয়ের বিপরীতে সম্ভাব্য আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর ফলে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি থাকবে ১ লাখ ২৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বিপুল ঘাটতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত বিদেশি সহায়তা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বিদেশি সহায়তা ছাড়ের পরিমাণ কমে আসছে। ফলে ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ তহবিলেই গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। অবশ্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সহজে অর্থ পাওয়া গেলেও এ খাতে ঋণের সুদ অনেক বেশি। এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাত থেকে নতুন অর্থবছরে ৫৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে বছরজুড়েই ব্যাংকিং খাত চাপে থাকবে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। একই সময়ে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এ হিসাবে এবার সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে ঘাটতি বাড়ছে ১৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধির হার ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নিয়ম মেনে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকছে বাজেটের ঘাটতি। অবশ্য চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। এর ফলে বাজেটে ঘাটতি নেমে এসেছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪১ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৬-১৭, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে পাঁচ শতাংশ করে ঘাটতি ছিল। আর ২০১৩-১৪ এবং ২০১২-১৩ বছরে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ঘাটতি পূরণ করতে অভ্যরীণ অর্থায়নে সরকারের নির্ভরতা বাড়ছে। এ খাত থেকে আগামী অর্থবছর ৮৯ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু ব্যাংক খাত থেকেই নেওয়া হবে ৫৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এ খাত থেকে ২৮ হাজার ২০২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ হিসাবে এক বছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়বে ৩১ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ কম নেবে। যে কারণে ব্যাংকিং খাত থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। কারণ সঞ্চয়পত্র খাত থেকে বেশি ঋণ নেওয়া সরকারকে মাত্রাতিরিক্ত সুদ পরিশোধ করতে হয়। সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে চাপ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিলে কম সুদ গুনতে হবে। সরকারের ব্যয়ও কমবে। যে কারণে ব্যাংকিং খাত থেকে বেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে। নতুন অর্থবছর ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ এবার কমাতে চায় সরকার। এ খাতে নতুন অর্থবছর ২৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্য চলতি বাজেটের তুলনায় ২ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা কম।
চলতি বাজেট ঘাটতি মেটাতে বড় ধরনের ঋণ নেওয়া হয় সঞ্চয়পত্র খাত থেকে। শুরুতে কম লক্ষ্য ধরা হলেও বছরের শেষে এর পরিমাণ ৪৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অবকাঠামো খাতের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজেটের আকার বাড়ছে। বিদেশি সহায়তা বাড়িয়ে এসব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় প্রয়োজন ও বাস্তবতার আলোকে যৌক্তিক আকারের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংকিং খাত থেকে বাড়তি ঋণ নেওয়া হলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বন্ধ হয়ে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। ঘাটতি অর্থায়নে বিদেশি নির্ভরতা কমাতে চায় সরকার।
এবার বিদেশ থেকে ৪২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছর বাজেটে বিদেশি ঋণ ধরা হয়েছিল ৫৫ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা।এ হিসাবে ১২ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা কম ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। বিদেশি ঋণ পরিশোধের পর নতুন বাজেটে নিট বিদেশি সহায়তা দাঁড়াবে ৩৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে ৪২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকার ঋণের পাশাপাশি অনুদান ধরা হয়েছে ১০ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। সব মিলে বিদেশি সহায়তা বাবদ আসবে ৫২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। একই সময়ে ১৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করা হবে। সব মিলে নিট বিদেশি সহায়তা ধরা হচ্ছে ৩৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় বিদেশি ঋণ পাওয়া কিছুটা কঠিন হয়ে আসছে। পাশাপাশি ঋণ নির্ভরতা থেকে সরকারও দেশকে বেড় করে আনতে চাইছে। পদ্মা সেতুসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এ অবস্থায় দেশের উন্নতি নিশ্চিত করতে আগামীতে অভ্যন্তরীণ তহবিলেই জোর দিচ্ছে সরকার।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন