ভরা মৌসুমেও কেন বাড়ছে চালের দাম?
চালের বাজারে অস্থিরতা যেন কাটছেই না। এ মৌসুমে বাজারে চালের সরবরাহ সবচেয়ে বেশি থাকে। গত কয়েক দিনে চালের বাজারে যেভাবে দাম বেড়েছে, তা অস্বাভাবিক। বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, কোনো একটি সুনির্দিষ্ট কারণ কেউই শনাক্ত করতে পারছেন না। তবে বেশ কয়েকটি বিষয় একযোগে কাজ করছে এর পেছনে। বাজারে অনুসন্ধান চালিয়ে এবং চাল উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে চালের দাম বাড়ার ৯টি কারণ শনাক্ত করা গেছে।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে চালের ঘাটতি আছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা মজুদদারি করছেন। আবার বাজারে ঘাটতি আতঙ্কও নানাভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘এই মৌসুমে চালের বাজার অস্থির হওয়ার কথা নয়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বাজারে চালের দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ার বিষয়টি আসলে আমরা নিজেরাও হিসাব করে পাই না।’
সংশ্লিষ্টদের দাবি, দেশে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ধান উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের পূর্বাভাস এবং তা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার, সংকট পুঁজি করে অনৈতিক মুনাফার আশায় ধান-চালের মজুদ, বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়া ও দাম বেড়ে যাওয়া, চালকলে চাল উৎপাদন আগের তুলনায় কমে যাওয়া, খোলাবাজার থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ধান-চাল কেনা, সরকারিভাবে চাল আমদানি না হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া দাম এবং ২৫ শতাংশ শুল্কভার নিয়ে চাল আমদানিতে বেসরকারি খাতের নিরুৎসাহিত মনোভাব এবং ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে চাল উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণেই মূলত চালের বাজার অস্থিতিশীল।
জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘ভরা মৌসুমে দেশে চাল নিয়ে এমন অস্থিরতা তৈরি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেটিই হচ্ছে।’ তিনি এর কারণ হিসেবে বলেন, ‘এমন হতে পারে, কোনো ব্যবসায়ীই কোনো নিয়ম-কানুন মানছেন না। হতে পারে, কারো কারো অতি লোভে এ রকমটাও হতে পারে। কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু করছে কি-না সেটিও যাচাই করে দেখতে হবে।’
দেশে সর্বাধিক ধান উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়ে এই ফলন গড়ায়। যার থেকে উৎপাদিত ধানের ৫৮ ভাগ সরবরাহ মেলে। এরপর শুরু হয় আউশের মৌসুম, যার ফলন বাজারে গড়াবে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই। ফলে চালের সরবরাহ আরো বাড়ার কথা। তাহলে চালের দামে এত অস্থিরতা কেন? নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা বলেন, চালের বাজারে অস্থিরতার পেছনে রয়েছে ঘাটতি। চাল ব্যবসায়ীদের যেটা হিসাব, সেটা হলো ধান উৎপাদনে ঘাটতি আছে। তবে কী পরিমাণ ঘাটতি আছে, সরকার তার হিসাব স্পষ্ট করছে না। নানা মাধ্যমের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়ীদের ধারণা জন্মেছে, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দেশে ধান উৎপাদন ঘাটতি ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন। মূলত এটিই হলো অস্থিরতার বড় কারণ। আবার এটাও সত্য, এই মৌসুমে চালের বাজার অস্থির হওয়ার কথা নয়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বাজারে চালের দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ার বিষয়টি আসলে আমরা নিজেরাও হিসাব করে পাই না। তবে ধারণা করছি, বেশ কিছুদিন ধরে নানা মাধ্যমে বলা হচ্ছে, বিশ্ব খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে। এ ধরনের সংবাদ পেলে আমাদের তো একটা চরিত্র আছে সুযোগ নেয়ার। ভোক্তাদের বেলায় তারা বেশি বেশি কেনেন। লাগবে এক বস্তা, নিয়ে যান দুই বস্তা। এতে প্যানিক সৃষ্টি হয়। বাজার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আবার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছে, তারাও একটু সুযোগ নেয়।
এছাড়া ইদানীং দেশে যেসব বড় বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো বাজারে এসেছে, নানা আশঙ্কা থেকে তারা বড় লটে মার্কেট থেকে ধান-চাল কিনে নিয়েছে। তারা প্যাকেজিং চাল বাজারজাতকরণের উদ্দেশে বাজার থেকে একটা বড় পরিমাণ পণ্য তুলে নিচ্ছে। তাদের দেখে অন্যান্য সাধারণ ব্যবসায়ীও এর সুযোগ নিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাজারে এখন ধানের সংকট চলছে। কেউ তেমন আর ধান বিক্রি করছে না। ধানের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে দামও। মিনিকেট চাল তৈরি হয় এমন ধানের মণপ্রতি দাম এখন ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা, যা মাস কয়েক আগেও ছিল ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। আবার এই বাড়তি দামেও চাহিদা অনুযায়ী ধান পাচ্ছেন না মিলাররা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশ্ন, ধান না পেলে মিলগুলো চাল উৎপাদন বাড়াবে কীভাবে? এর সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যোগ হয়েছে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি। এতে ধান থেকে চাল উৎপাদন খরচ কেজিতে বেড়েছে ২ টাকা। ফলে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হচ্ছে, তা বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। সেই বাড়তি দামের চাল ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে আরো বাড়তি দামে। কারণ মিলগুলো থেকে চাল পরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৬০ পয়সা এবং ৫০ কেজির বস্তায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এতে ঢাকার খুচরা বাজারে চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৬ টাকায় এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৬ টাকায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কাওসার আলম খান বলেন, ‘বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের ইস্যুটি দেশে প্যানিক সৃষ্টি করেছে। তার ওপর দেশে চাহিদা অনুযায়ী ধান-চালের সরবরাহে ঘাটতিও আছে। আবহাওয়াও এবার খারাপ ছিল। প্রথম যখন ধান লাগায়, তখন পানি নেই। তারপর বৃষ্টি। যখন কাটতে যায় তখন পানির নিচে। শুধু হাওরেই নয়, বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টিতে ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সবাই সচেতন। বিভিন্ন মাধ্যমে এ খবর চাউর হওয়ার পর কৃষক থেকে ব্যবসায়ী যার যে পরিমাণ ধান-চাল আছে, তারা পকেটে পকেটে মজুদ করেছে। কেউ বাজারে ছাড়তে চাইছে না।’ বাবুবাজারের এ চাল ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়ার পেছনে দেশে ধানের বাজারে সরবরাহ সংকটকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন