হত্যার হুমকি !
ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিলেন সেই মানববাদী বিজ্ঞান লেখক ও মানবাধিকারকর্মী
কলারোয়ার সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের পছন্দের সেলুন সুবাস সরকার হেয়ার কাটিং। শুধু চুল, দাঁড়ি কাটার জন্যই নয়, আড্ডা দিতেও সেখানে ভীড় জমান অনেকে। ঐ স্থানকে বন্ধুদের মিলনমেলা বলে থাকেন অনেকে। এমনই এক বন্ধুত্বের আড্ডা যে বিভিষীকাময় বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করবে কোন একদিন তা কে ভেবেছিল ? সময়টা গতকাল ২১ শে জুন, ২০২২ ইংরেজী, মঙ্গলবার, সন্ধ্যা। অন্য দিনের মতো সেখানে আড্ডা দিতে বসেন বিজ্ঞান লেখক ও নিজেকে মানববাদী বলে দাবী করা মানবাধিকারকর্মী এস এম সাইফুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন রবি টেলিকমে কর্মরত জনাব হুমায়ুন কবির সাগর। আড্ডা চলাকালীন সময়ে সেখানে মোটরসাইকেলে এসে হাজির হয় মুখে লম্বা দাঁড়িওয়ালা এক লোক। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু সেই সন্ধ্যাটা হয়ে উঠে বিভিষীকাময়।
জানা যায় উক্ত আগন্তুকের নাম শাহীন রানা। শাহীন রানা এসেই এস এম সাইফুর রহমানকে সেখানে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে তাকে একের পর এক জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসে, এক পর্যায়ে আক্রমন করে বসেন। জনাব সাইফুর প্রচন্ডভাবে আহত হন। সম্পূর্ণ অপ্রাসাঙ্গিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনাব সাইফুরের লেখালেখির প্রসঙ্গ নিয়ে এসে তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকে। উপস্থিত অন্য দুইজন জনাব সাগর ও দোকানদার সুবাস সরকার বারংবার অনুনয় বিনয় করে নিষেধ করা স্বত্বেও তিনি তার মারমুখী উগ্র আচরন প্রদর্শনে অনঢ় থাকেন। এক পর্যায়ে সমকামীদের অধিকারের পক্ষে ও প্রকৃতিতে অন্য প্রাণীতেও সমকামীতা থাকার উদাহরন নিয়ে জনাব সাইফুরের লেখার জন্য তিনি গালমন্দ করেন, এগুলো ইসলাম ধর্মে নেই দাবী করে তিনি তার শরীরের মাসল দেখিয়ে তাকে মারার ও মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করেন প্রকাশ্যে। তিনি তার বলিষ্ট শরীরের মাসল দেখিয়ে বলেন ‘এই মাসল তৈরি করেছি তোদের মতো ধর্মদ্রোহীদের মারার জন্য, এরপর ইসলাম ধর্মের বিপক্ষে যায় এমন আর কিছু লিখলে তোকে কিন্তু শেষ করে ফেলবো, যেখানেই থাকিস সেখানে গিয়ে মেরে আসবো। আমরা অনেক, তুই একা, মসজিদ থেকে শত শত ঈমানদারকে সঙ্গে নিয়ে তোকে তোর বাড়ি থেকে ধরে এনে শেষ করে দিবো।’ এগুলো বলতে বলতেই তিনি শারিরীক আক্রমন করে বসেন। হাতে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে জনাব সাইফুর অপরপাশে রক্ষিত লোহার দন্ডের উপরে পড়ে গিয়ে মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হন। অন্যরা তাকে নিবৃত্ত না করলে নাকি আরো ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারতো। উপস্থিত আক্রমন ও হুমকিতে আহত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে জনাব সাইফুর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এই প্রতিবেদক জনাব শাহীন রানার বক্তব্য জানার জন্য তার সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন।
জনাব সাইফুর এই প্রতিবেদককে জানান ‘আমি নীরব থাকাকে শ্রেয় মনে করেছিলাম। কিছু বললে সেখান থেকে বেঁচে ফিরে আসা সম্ভব হতো না হয়তো। দেশের যে পরিস্থিতি তাতে সাধারন মানুষ যারা ধর্মভীরু তারা যুক্তি ও যথার্থ কারন না জেনেই আমার বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারতো, এমনটা হয় প্রায় সবখানেই। অধিকাংশ সাধারন মানুষ কোন কিছু যাচাই করে দেখার আগেই ধর্মের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব ও অবস্থানে চলে যায়।’ তিনি জানান, এমন হুমকি তিনি প্রায়ই পান জঙ্গি, গোঁড়া, প্রতিক্রিয়াশীলদের থেকে তবে তার জন্মস্থানে বসে এমন হুমকি পাওয়াটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কয়েক মাস আগে তিনি তার কর্মস্থল, রুটি-রুজির কর্ম ত্যাগ করে ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরেছেন, নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য।
গতকাল নাজেহাল হয়ে, মারধোর ও হত্যার হুমকি পেয়ে তিনি আজ সকালে ভারতে প্রবেশ করেছেন। আর কয়েকদিন পরে অন্যতম বড় উৎসব ঈদ। ঈদের আগেই এভাবে যাওয়াটা তার জন্য বেদনাদায়ক হলেও জীবনের নিরাপত্তার তাগিদে তিনি ভারতে প্রবেশ করেছেন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান ভারতে যতদিন পারেন থাকবেন, সেখান থেকে ফিরে অন্য কোন দেশে পাড়ি দেবেন সুযোগ হলে। এভাবে মৃত্যু হুমকি মাথায় নিয়ে আর কতদিন ?
উল্লেখ্য যে, এর আগে তিনি তাকে অব্যহত হুমকি প্রদানের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রামপুরা মডেল থানায় একটি সাধারন ডায়েরি করেন। তার ভাষ্যমতে পুলিশ তাকে বার বার দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু জন্মভূমি ছেড়ে তিনি সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেন দেশ ছাড়বেন, পুলিশের সেসব কর্মকর্তারা এর কোন সদুত্তর দিতে পারেন না। তার ধারনা পুলিশ বাহিনীর কিছু মৌলবাদী চেতনার সদস্যের সঙ্গেও জঙ্গিদের সম্পর্ক থাকতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোও মানববাদী, মানবাধিকারকর্মীদের পক্ষ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের মতাদর্শকে ঘেটে জনপ্রিয়তা হারাতে চায় না।
জনাব এস এম সাইফুর রহমান জানান, মানুষের অধিকারের পক্ষে, নারীদের পোশাকের স্বাধীনতার কারনে, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখালিখির কারনে একপ্রকার পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার, ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানমুখী মানবিক শিক্ষা ব্যবস্থা এসব নিয়ে লেখা ও মত প্রকাশ করা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভিন্নমতাদর্শের লেখক, কবিদের হুমকি, হত্যার ইতিহাস পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের হলেও ২০১৩ সালে জঙ্গিরা প্রকাশ্যে একসঙ্গে বাংলাদেশের ৮৪ জন ব্লগার, এক্টিভিস্টের তালিকা করে নাস্তিক উপাধি দিয়ে তাদের হত্যার ঘোষনা দেয়। অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, নাজিমুদ্দিন সামাদ, নীলয় নীল, রাজীব হায়দার, অধ্যাপক রেজাউল করীম সিদ্দিকী, শাহজাহান বাচ্চু, ফয়সাল আরেফিন দীপনসহ অনেকে রাস্তায় ও বাড়িতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন। মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে মাথায় ও ঘাড়ে গুরতর জখম হন তার স্ত্রী ও অন্য মার্কিন নাগরিক লেখিকা বন্যা আহমেদ। অভজিৎ রায় ঘটনাস্থলেই মারা যান, দীর্ঘ দিনের চিকিৎসায় বন্যা আহমেদ জীবন ফিরে পান। এর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মম আক্রমনের শিকার হন অধ্যাপক ও নাস্তিক লেখক ডক্টর হুমায়ুন আজাদ, যে হামলার জেরে তিনি পরবর্তীতে মারা যান। জঙ্গিদের ভয়ে জীবন বাঁচাতে অনেক ব্লগার, এক্টিভিস্ট জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে অন্যদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বিদেশে আশ্রয় নেয়া ব্লগার এক্টিভিস্টদের মধ্যে আসিফ মহীউদ্দিন, ইব্রাহীম খলিল সবাক, মাহমুদুল হাসান মুন্সি, সুসুপ্ত পাঠক, অমি রহমান পিয়াল, মাহবুব আলম কিন্তু, আসাদ নূর, সানিউর রহমান উল্লেখযোগ্য।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন