ভোটের বাজেটে কী পেলেন ভোটাররা?
বাজেট নিয়ে আলোচনা যেমন ছিল, শেষ পর্যন্ত তাই হলো। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মাথায় রেখেই নতুন অর্থবছরের (২০১৮-১৯) জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী অাবুল মাল আব্দুল মুহিত। প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার ঘাটতি নিয়েও বিপুল এ বাজেটে আগের বছরের মতো জনগণের ওপর করের বোঝা চাপাননি তিনি। বরং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় আরো বাড়িয়ে জনকল্যাণের কথা ভেবেছেন।
চিন্তা করেছেন বিনিয়োগকারীদের কথাও। তাদেরকে টানতে বাজেটে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করেছেন। যদিও এই বাজেটের বেশিরভাগ আয় আসবে আয়কর, কর, আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক এবং ভ্যাট থেকে। বাকিটা নির্ভর করতে হবে ঋণের ওপর।
সবকিছু মিলিয়ে কী পেলেন সেই ভোটাররা? আর সাধারণ মানুষের জন্যই বা কী থাকছে? পাঠকদের জন্য বিস্তারিত তুলে ধরেছেন তপু রায়হান।
বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, আবাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
সামাজিক অবকাঠামোগত খাতে দেয়া হয়েছে মোট বরাদ্দের ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এরমধ্যে মানব সম্পদ খাতে- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে ২৪.৩৭ শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো খাতে ৩০.৯৯ শতাংশ। কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১২.৬৮ শতাংশ, বৃহত্তর যোগাযোগ খাতে ১১.৪৩ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৫.৩৬ শতাংশ।
এনার্জি ড্রিংক পানে পয়সা লাগবে বেশি
তীব্র গরমে বা ক্লান্ত হয়ে যারা এনার্জি ড্রিংকে স্বস্তি খোঁজেন তাদের জন্য দুঃসংবাদ। পণ্যটির স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে এর ব্যবহার কমানোর উদ্দেশ্যে পণ্যটিরও উপর ২৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের স্থলে ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
খরচ বাড়ছে রূপচর্চার
নারীদের প্রসাধন সামগ্রী এবং ত্বক পরিচর্যার প্রসাধন সামগ্রী (ঔষধে ব্যবহৃত পদার্থ ব্যতীত),সানস্ক্রিন বা সান ট্যান সামগ্রী; হাত, নখ বা পায়ের প্রসাধন সামগ্রীর উপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে। বাণিজ্যে সমতা বিধানের লক্ষ্যে সমজাতীয় অন্যান্য সামগ্রীর উপরও ১০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে।
এছাড়া পুরুষের শেভের সময় বা শেভের আগে বা পরে ব্যবহার্য সামগ্রী, শরীরের দুর্গন্ধ এবং ঘাম দূরীকরণে ব্যবহৃত সামগ্রী (আতর ব্যতীত), সুগন্ধযুক্ত বাথ সল্ট এবং অন্যান্য গোসল সামগ্রী, কক্ষের দুর্গন্ধ দূরীকরণে ব্যবহৃত অন্যান্য সুগন্ধি সামগ্রী (আগরবাতি এবং সমজাতীয় পণ্য ব্যতীত) ও সমজাতীয় অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার সীমিত করার লক্ষ্যে সম্পূরক শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিদেশি চকোলেট খেতে গুণতে হবে বেশি পয়সা
আদরের সোনামনির পছন্দের চকোলেটের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় স্থানীয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভিন্ন শিল্প যেমন-মধু, চুইংগাম ও সুগার কনফেকশনারি, চকোলেট ও কোকোয়া সমৃদ্ধ খাদ্য, বাদাম, সিরিয়াল, ওটস ইত্যাদির প্রতিরক্ষণের স্বার্থে এসমস্ত খাদ্য উপকরণ বাল্কের হ্রাস কৃত শুল্কহার অব্যাহত রেখে খুচরা মোড়কে সরাসরি বিক্রয়ের জন্য আমদানিতে শুল্কহার ২৫ শতাংশে বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে কোকাযুক্ত চকোলেট এবং ফিনিস্ড চকোলেট এর ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২০ শতাংশ শুল্কের পরিবর্তে ৪৫ শতাংশ শুল্কের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিড়ি-সিগারেটের দাম বাড়ছে
বিড়ি-সিগারেটের উপর বিদ্যমান ৪৫ শতাংশ শুল্ক অব্যাহত রাখা হয়েছে। এছাড়া সিগারেট পেপার ও বিড়ি পেপার এর উপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে দাম বাড়বে এই পণ্যটির। তবে তামাক প্রক্রিয়াজাতপূর্বক রপ্তানি উৎসাহিত করতে তামাকজাত পণ্যের উপর আরোপিত ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে করে তামাকজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়ে দেশের বাজারে দাম বৃদ্ধিতেও ভূমিকার রাখতে পারে।
বাড়বে আমদানি করা ইলেকট্রনিক ডিভাইস
আমদানি করা মোবাইল ও ব্যাটারি–চার্জার আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, দেশীয় ইলেকট্রিক শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের প্রতিরক্ষণের সুবিধার্থে মোবাইল ব্যাটারি চার্জার, ইউপিএস/আইপিএস ও ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের শুল্ক ১৫ শতাংশে; অটোমেটিক সার্কিট ব্রেকারের শুল্ক ১০ শতাংশে বাড়ানো হয়েছে; এবং ল্যাম্প হোল্ডারের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসাথে এ সকল শিল্পের কতিপয় কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বিভিন্ন হারে হ্রাসের প্রস্তাব করছি।
অনলাইন কেনা কাটার খরচ বাড়ছে
বর্তমানে ইন্টারনেট বা সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পণ্য বা সেবার পরিসরকে আরো বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ভার্চুয়াল বিজনেস নামে একটি সেবার সংজ্ঞা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে অনলাইনভিত্তিক যেকোন পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তরকে এ সেবার আওতাভুক্ত করা সম্ভব হবে। তাই ভার্চুয়াল বিজনেস সেবার উপর ৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে আসন্ন বাজেটে। ফলে এই সেবাটির খরচ বাড়ছে।
রাইড শেয়ারিং সেবার দাম বাড়বে
এখন হতে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে উবার-পাঠাও বা অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ভাড়ার ওপর। এছাড়া অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে দিতে হবে উৎসে কর। আর এসব সেবায় যারা যানবাহন দেবেন তাদের টিআইএন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) থাকতে হবে। সব মিলিয়ে এই সেবাটি নিতে গ্রাহকের কিছু বাড়তি পয়সা গুনতে হবে।
দাম বাড়ছে আমদানি করা চা-কফির
আমদানি করা চা বা কফির দাম বাড়তে পারে। কারণ এইসব পণ্যের আমদানি শুল্ক এতোদিন না থাকলেও নতুন করে ২০ শতাংশ শুল্কের প্রস্তাব করা হয়েছে।
পলিথিন পণ্যে আরো শুল্ক
পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি ও পরিবেশ সুরক্ষার স্বার্থে পলিথিলিনের ব্যবহার কমানোর জন্য সকল ধরণের পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ (ওভেন প্লাস্টিক ব্যাগসহ) ও মোড়ক সামগ্রীর উপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ছোট ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে
আগামী অর্থবছর থেকে ছোট ফ্ল্যাট (১ থেকে ১১০০ বর্গফুট) কেনায় খরচ বাড়তে পারে। আর মাঝারি (১১০১ থেকে ১৬০০ বর্গফুট) ফ্ল্যাট কেনার খরচ কমতে পারে। কেননা বর্তমানে ১ থেকে ১১০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাট নিবন্ধনে ১ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। আর ১১০১ থেকে ১৬০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাট নিবন্ধনে ভ্যাটের হার রয়েছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরে এই দুই ধরনের ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে ২ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। যারা পুরনো ফ্ল্যাট কিনবেন তাদেরও খরচ বাড়তে পারে। কারণ নতুন অর্থবছরে পুরনো ফ্ল্যাট পুনঃনিবন্ধনে ২ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে।
এছাড়া ছাপাখানার পণ্যসহ বাড়তে পারে আরো কিছু পণ্য ও সেবার দাম। তবে আমদানি করা চাল বা বিদেশি চকোলেটের মতো পণ্যগুলোর দাম বাড়ানোর পেছনে দেশীয় শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় ইল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
স্কুলবাসে সুখবর
ঢাকা শহরে স্কুলগুলোতে শির্ক্ষাথীদের যাতায়াতের জন্য অধিকাংশ স্কুলেই কোন স্কুলবাস নেই। উন্নত দেশের ন্যায় স্কুলের জন্য ডেডিকেটেড স্কুলবাস চালু করে যানজট এবং ছাত্রদের স্কুলে যাতায়াত সহজতর ও নিরাপদ করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা এজেন্সি স্কুলবাস সার্ভিস চালুর আগ্রহ প্রকাশ করলে তা যথাযথ বিবেচনায় বিশেষ শুল্ক সুবিধায় আমদানির সুযোগ দেয়া হবে।
কৃষি জমিতে মূসক অব্যাহতি
কৃষি জমিসহ সকল প্রকার ভূমি রেজিস্ট্রেশনের উপর মূল্য সংযোজন কর বহাল ছিল। কিন্তু তা আদায় করা সম্ভব ছিল না। সবদিক বিবেচনায় কৃষি জমির উপর মূসক অব্যাহতি প্রদান করে মূল্য সংযোজন কর আইন-১৯৯১ এর দ্বিতীয় তফসিলে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে আসন্ন বাজেটে।
কমছে লোহ ও ইস্পাতের দাম
লৌহ ও ইস্পাত শিল্পে বিগত বছরগুলোতে আমদানির পরিমাণ ও রাজস্ব হ্রাস পেয়েছে। একই সাথে স্থানীয় বাজারে তৈরি রডের দামের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে। রডের উৎপাদন ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে এর কাঁচামাল ফেরো এ্যালয়ের রেগুলেটরি ডিউটি ১৫% হতে হ্রাস করে ১০% এবং স্পঞ্জ আয়রন আমদানিতে স্পেসিফিক কাস্টমস ডিউটি প্রতি মেট্রিক টনে ১,০০০ টাকা হতে হ্রাস করে ৮০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
হাইব্রিড মোটরকার ও পুরাতন গাড়ি
হাইব্রিড মোটর গাড়ির আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশ দূষণ এবং জ্বালানি ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য হাইব্রিড মোটর গাড়ির আমদানি উৎসাহিত করার জন্য নিম্ন সিসির হাইব্রিড মোটর গাড়ি (১৬০০ হতে ১৮০০ সিসি পর্যন্ত) আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া পুরাতন গাড়ি আমদানির অবচয় সুবিধা বছর ভিত্তিক ৫ শতাংশ হারে হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ডাবল কেবিন পিকআপের ব্যবহার দেশে ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং এক্ষেত্রে রেগুলেটরি ডিউটি বিদ্যমান ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ক্যানসারের ওষুধ
নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে ক্যানসার ও কিডনি জাতীয় রোগের প্রতিষেধক হিসেবে Erythropoietin নামের ওষুধকে আমদানি পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
রেফ্রিজারেটর এবং কম্প্রেসার শিল্প
দেশে বর্তমানে উন্নত মানের রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনার তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় এ সকল শিল্পকে প্রতিরক্ষণের লক্ষ্যে এ খাতে ব্যবহৃত কতিপয় উপকরণের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশে এবং ওয়েল্ডিং ওয়্যার, স্প্রিং ও গ্যাসকেটে আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশে হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে।
টায়ার টিউব উৎপাদন
টায়ার টিউব উৎপাদন শিল্পের কাঁচামাল প্যারফিন ওয়াক্স আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশে ফেনোলিক রেজিন আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশে হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে।
গুঁড়া দুধ ও পাউরুটি
পূর্ণ ননীযুক্ত গুঁড়া দুধের সমজাতীয় পুষ্টি উপাদানে তৈরি ফিল্ড মিল্ক পাউডার নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিবেচনায় পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন- মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় উক্ত পণ্য আমদানিতে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গুঁড়া দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের কাঁচামাল ফিল্ড মিল্ক পাউডার বাল্ক আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশে হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর প্রতি কেজি ১০০ (একশত) টাকা মূল্যমান পর্যন্ত পাউরুটি, বনরুটি, হাতে তৈরি বিস্কুট এবং ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) টাকা পর্যন্ত হাতে তৈরি কেক (পার্টিকেক ব্যতীত) এর উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পোল্ট্রি ও ডেইরি
কৃষির অন্যতম উপখাত এবং দেশের মানুষের আমিষের প্রধান উৎস মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে উক্ত খাতের খাদ্য সামগ্রী ও নানাবিধ উপকরণ আমদানিতে আমরা বিগত কয়েক বছর শুল্ক ও কর অব্যাহতি দিয়ে আসছি। এই খাতে প্রদত্ত প্রণোদনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পোল্ট্রি ফিডের প্রয়োজনীয় উপকরণ সয়াবিন অয়েল কেক/ফ্লাওয়ারে শুল্ক হ্রাস করে শূন্য শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি ৫ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশি মোটরসাইকেল
পরিবহন খাতের উদীয়মান একটি উপখাত হলো মোটরসাইকেল উৎপাদন। দেশে ইতোমধ্যেই ৩-৪ টি প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করেছে। একটি প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে তাদের উৎপাদিত মোটরসাইকেল রপ্তানিও শুরু করেছে। মোটরসাইকেলের স্থানীয় উৎপাদন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ খাতের জন্য শর্তসাপেক্ষে রেয়াতি সুবিধা প্রদান করে বিগত অর্থবছরে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। মোটর সাইকেল উৎপাদন খাতে প্রদত্ত প্রণোদনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি মোটর সাইকেল ও এর পার্টস উৎপাদনে কতিপয় পণ্যে শুল্ক সুবিধা যৌক্তিকীকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশে তৈরি মোবাইল ফোন
দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন কার্যক্রমকে প্রণোদনা প্রদানের উদ্দেশ্যে ‘মোবাইল টেলিফোন সেট’কে উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করে একটি আলাদা প্রজ্ঞাপন জারীর প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া স্থানীয় মোবাইল উৎপাদনের উপর সারচার্জ অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করারও প্রস্তাব করেন তিনি।
আরও সুবিধা
কর বা শুল্ক আরোপের কারণে বাজারে নিত্য পণ্যের দামে নিয়ে জনগণের ওপর মিশ্র প্রভাব পড়লেও দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য প্রতি বছরের মতো এবারও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় কিছু সুযোগ বাড়ানো হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা বলয়
সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য প্রতি বছরের মতো এবারও অনেক কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এতে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে আরও ১১ লাখ মানুষকে। নতুন বাজেটে বয়স্ক ভাতা ভোগীর সংখ্যা ৪০ লাখ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া বিধবা ভাতা ভোগীর সংখ্যা ১৪ লাখে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন ৮ লাখ ২৫ হাজার জন হলেও নতুন বাজেটে এ সংখ্যা বাড়িয়ে ১০ লাখ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ভাতা পাওয়া ৬ লাখ বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ লাখ। ভিজিডি কার্ডধারীর সংখ্যা ১০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ ৪০ হাজার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মায়ের (শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান যেসব মা) সংখ্যা ২ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন বাজেটে ভাতা ভোগীদের সঙ্গে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ভাতার পরিমাণও। এছাড়া হিজড়াসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতার পরিমাণ বাড়বে বলেও বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় কিডনি, স্ট্রোক, ক্যানসার, প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচিতে অর্থ বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পাশাপাশি আরও থাকছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ১০ হাজার, জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিতে চা শ্রমিক ১০ হাজার, দারিদ্র্য মাতৃত্বকালীন মা ১ লাখ, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মা ৫০ হাজার ও ভিজিডির সুবিধাভোগী ৪০ হাজার। নতুন বাজেটে এ কর্মসূচির আওতায় সুবিধা পাবেন ১৪ লাখ নারী।
এছাড়া বর্তমানে ৩০ হাজার চা শ্রমিক জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ভাতা পাচ্ছেন। প্রস্তাবিত বাজেটে এ সংখ্যা আরও ১০ হাজার বাড়িয়ে ৪০ হাজার করা হচ্ছে। এদিকে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর গোষ্ঠীর ভাতাও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রাথমিক স্তরে ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতাসহ হিজড়া, বেদের উপবৃত্তি প্রাথমিক স্তরে ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৪৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১০০০ থেকে বাড়িয়ে ১২০০ টাকা নির্ধারণ করা হবে বলে জানা গেছে। আসছে বাজেটে মাতৃত্বকালীন ভাতা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হচ্ছে। এ দুটি ভাতা পাওয়ার মেয়াদ ২ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩ বছর করারও প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মায়ের ভাতাও ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হবে।
অার্থিক খাতে সুবিধাদি
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় বিদ্যমান বিধিবিধান প্রয়োগের পাশাপাশি কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারি ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংকসমূহে আমানত ও ঋণের সুদ/মুনাফা হার মাসে শুধুমাত্র একবার পরিবর্তন এবং পরিবর্তিত সুদ হার তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্ব স্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেন তিনি।
এছাড়া ঋণ এবং আমানতের গড় ভারিত সুদ হারের ব্যবধান ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা, পুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়তা তহবিল পরিচালনা, বৃহৎ ঋণ খেলাপি মনিটরিং এর জন্য বিশেষায়িত সফটওয়্যার চালুকরণ, স্বল্প সুদে ও সহজশর্তে বিভিন্ন পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় বিভিন্ন ধরণের ঋণ সুবিধা প্রদান, ব্যাংকিং সেবা বিষয়ক অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে গ্রাহক সেবা সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনসহ আরো কিছু পদক্ষেপেরে কথা বলা হয়েছে এবারের বাজেটে।
কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটের শিরোনাম ছিলো ‘সমৃদ্ধ আগামীর অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন