ভয়াল ২৯ এপ্রিল: এখনো অরক্ষিত কক্সবাজারের উপকূল
আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এই দিনে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাট ইউনিয়নের ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৭ কিলোমিটারই ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। ফলে এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত আতঙ্কে কাটে এখানকার মানুষের দিন।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই দুই ইউনিয়ন। এখানে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। মাটির সঙ্গে মিশে যায় ঘরবাড়ি।
সরেজমিন দেখা গেছে, মাতারবাড়ী ইউনিয়নের উত্তর রাজঘাট ও সাইটপাড়ার পশ্চিম পাশের প্রায় আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জোয়ারের পানি ধাক্কায় ধসে গেছে। আর যে অংশ রয়েছে তা যেকোনো মুহূর্তে ধসে গিয়ে মাতারবাড়ী পানিতে ডুবে যেতে পারে। ধলঘাট ইউনিয়নের অবস্থা আরও খারাপ। সরইতলা থেকে ভারত ঘোনা এলাকা পর্যন্ত বেড়িবাঁধ অরক্ষিত। তবে ধলঘাট ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবোর অর্থায়ানে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ব্যয়ে নৌ-বাহিনী তত্ত্বাবধানে বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য চলছে ব্লক নির্মাণের কাজ। তবে এখনো বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হয়নি।
সুতুরিয়া বাজার এলাকার রক্ষা বাঁধ ও বেড়িবাঁধের ভাঙা ভারত ঘোনার সামান্য যে অংশ রয়েছে সেটি যেকোনো মুহূর্তে জোয়ারের পানিতে ধসে যাওয়ার আতঙ্কে দিন কাটছে ধলঘাটার বাসিন্দাদের। তেমনটা হলে পুরো ইউনিয়ন সাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে বলে মনে করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয় লোকজন জানান, বর্ষার আগে বাঁধ সংস্কার না হলে মাতারবাড়ী ও ধলঘাটার ১৬ গ্রাম লোকালয়ে জোয়ার-ভাটা চলবে। এখনো হাতে যে সময় আছে তা কাজে লাগিয়ে বাঁধ সংস্কার জরুরি।
মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. উল্লাহ বলেন, স্থায়ি বেড়িবাঁধ না থাকায় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে এই এলাকার কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এরপর দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও চারপাশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়নি।
চেয়ারম্যান বলেন, মাতারবাড়ি রক্ষা করতে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তিনি বলেন, মাতারবাড়ীতে বাস্তবায়নাধীন বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো দাবিই এখনো পূরণ হয়নি। এ ছাড়াও কোল পাওয়ার জেনারেশন মাতারবাড়ি ইউনিয়নে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে পুরো ইউনিয়নে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে এমন অভিযোগও রয়েছে। এরই মধ্যে দুইটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণের ফলে পানি চলাচলের জন্য নির্মিত সমস্ত স্লুইচ গেইট বন্ধ হয়ে গেছে। এটিই এখন মাতারবাড়ির মানুষের আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউনিয়নটি বঙ্গোপসাগরের মোহনায় হওয়ায় যেকোনো মুহূর্তে উত্তর রাজঘাট ও ষাইটপাড়ার বেড়িবাঁধ ভেঙে পুরো এলাকা সাগরে গর্ভে তলিয়ে যাবে। মাতারবাড়ীকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ফলে স্থানীয় লোকজন ধীরে-ধীরে ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে।
বিষয়টি জানিয়ে ইতোমধ্যে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, কোলপাওয়ার জেনারেশন ও মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে আবেদন করেছেন মাতারবাড়ীর চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ।
জানা গেছে, অবিলম্বে মাতারবাড়িতে পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই এসব কাজ বাস্তবায়ন করার জন্য বলেছেন। তারপরও কেন হচ্ছে না তা মাতারবাড়ির মানুষ জানতে চায়।
ইতোমধ্যে উত্তর রাজঘাট ও পশ্চিম পাশের বেড়িবাঁধের ভয়াবহ অবস্থা। জোয়ারের পানি প্রবেশ করার সুযোগ থাকলেও তার বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে। যার ফলে জমি হারানো লোকজন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
মাতারবাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক দুটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে জাপানের জাইকা এবং সিংঙ্গাপুরের অর্থায়নে। ইতোপূর্বে মাতারবাড়ির ৮০ হাজার মানুষ সময়ে অসময়ে তাদের ন্যায্য কিছু দাবি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরে বহুবার উপস্থাপন করার পরও ন্যূনতম দাবিও এখনো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। প্রকল্প কার্যক্রম শুরু করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন স্টক হোল্ডারের সভায় পুনর্বাসনের নামে ২১ ক্যাটাগরির ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না।
এদিকে কর্মহারা শ্রমিকদের পুনর্বাসনে এবং চাকরির অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণা আছে, বাস্তবে নাই। বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভেতরে যেসব কাজ মাতারবাড়ির মানুষ পারবে এতেও বাইরের লোক এনে কাজ করানো হচ্ছে।
ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, বাঁধ মেরামত না হওয়ায় আতঙ্কে কাটছে কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষের দিন। দুর্যোগ কবল থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষা করতে হলে আপাতত বাজার রক্ষা বাঁধ ও ভারত ঘোনা ভাঙা অংশ মেরামত ধলঘাটবাসীর প্রাণের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বার বার বলার পরও ভাঙা অংশ মেরামতের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
ধলঘাট আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছালেহ আহমদ বলেন, ‘দুর্যোগ থেকে বাঁচতে সাত বছর আগে সপরিবারে কালারমারছড়া নয়াপাড়া এসে নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছি।’
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের পর স্থানীয় লোকজনের আশ্রয় নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়ানে এ উপজেলায় ৮৩টি আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এসব আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনের পর থেকে কোনো রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কার না হওয়ায় প্রায় ৪০টি আশ্রয় কেন্দ্র ব্যবহারের অনুপযোপগী হয়ে পড়েছে। উপজেলার বর্তমান সাড়ে চার লাখ মানুষের বসবাস হলেও জনসংখ্যা অনুপাতে আশ্রয় কেন্দ্রর সংখ্যা অতি নগণ্য।
জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যে ধলঘাট ইউনিয়নের অরক্ষিত বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৬০ কোটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ব্লক নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো কাজ চলছে। তবে ভারত ঘোনাসহ ভাঙা অংশ মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট নৌ-বাহিনীর কর্তৃপক্ষকে আমাদের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা রাখি শিগগির মেরামত কাজ শুরু হবে। এছাড়া মাতারবাড়ী ধসে যাওয়া বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ হাতে পেলেই ভাঙা বেঁড়িবাধ মেরামত করা হবে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও জাইকাকে অবহিত করা হয়েছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন