মধ্যরাতে সরানো হলো সুপ্রিম কোর্টের সেই গ্রিক দেবী ভাস্কর্য

সুপ্রিমকোর্ট চত্বর থেকে বহুল আলোচিত গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ভাস্কর্যটি সরানোর কাজ শুরু করা হয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্য সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃপক্ষই সরাচ্ছে। ভাস্কর্যটির নির্মাতা শিল্পী মৃণাল হক গভীর রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

তিনি বলেন,বৃহস্পতিবার তাকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কে এ নির্দেশ দিয়েছেন তার বা সেই প্রতিষ্ঠানের নাম তিনি প্রকাশ করেননি। তিনি বলেন, কে নির্দেশ দিয়েছেন তা আপনারা সবাই জানেন।

উপরের চাপ আছে, আমি বলতে পারব না। শিল্পকর্মটি যাতে ভেঙে না যায় বা নষ্ট না হয় সে কারণে তিনি রাতেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। গ্রিক দেবী নয় এটি শাড়ি পরা বাঙালি নারীর ভাস্কর্য।

এর ডান হাতে একটি তলোয়ার আর বাম হাতে দাঁড়িপাল্লা নিয়ে দাঁড়ানো নারী। ভাস্কর্যটি সরানোর প্রতিবাদে রাতেই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা সুপ্রিমকোর্টের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে ভাস্কর্যটি স্থাপনের পর থেকে হেফাজতসহ কয়েকটি ইসলামী সংগঠন এর বিরোধিতায় নামে। হেফাজত এ ভাস্কর্য সরানোর দাবি জানিয়ে সরকারকে ৫ মে মতিঝিলে ফের সমাবেশের হুমকি দেয়।

ওলামা লীগও তা অপসারণের দাবি জানায়। একটি সূত্র জানিয়েছে, গণপূর্ত অধিদফতর ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়ার কাজে সহায়তা করছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে এ কাজ হচ্ছে।

রাত ১২টার পর কয়েকজন শ্রমিক ভাস্কর্য সরানোর কাজ শুরু করেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে সুপ্রিমকোর্টের ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।

এ সময় আদালতের গেটের বাইরে সংবাদকর্মীসহ উৎসুক দর্শকের ভিড় জমে। তবে নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা কাউকে আদালত চত্বরে প্রবেশ করতে দেননি।

আদালতের বাইরের সড়কে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রাত তিনটার দিকে ভাস্কর্যটি কংক্রিট থেকে সরানোর কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসে।

সুপ্রিমকোর্টের গেটের বাইরে থেকে দেখা গেছে, শ্রমিকরা ভাস্কর্যটির নিচের দিকে কংক্রিটের অংশ বড় হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করছেন। এর চার পাশে বাঁশ দিয়ে এক ধরনের ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে।

কপিকল দিয়ে লোহার শিকল বাঁধা হয়েছে। নিচের দিকে ভাঙার কাজ শেষ হলে বাঁশের ফ্রেম এবং লোহার শিকল দিয়ে টেনে ট্রাকে উঠানো হবে। এজন্য একটি ট্রাকও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

শিল্পকর্মটি এখান থেকে সুপ্রিমকোর্টের এনএক্স ভবনের সামনে আপাতত রাখা হবে। রাত ২টার দিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভাস্কর্য সরানোর কাজ চলছিল।

রাত দেড়টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সুপ্রিমকোর্টের বাইরে কড়া নিরাপত্তা। ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি। তাদের দাবি, ভেতরে কী হচ্ছে তারা তা জানেন না। তবে বাইরে থেকে দেখা গেছে অন্তত ১৫ জন শ্রমিক সেখানে কাজ করছিলেন।

এদিকে রাত দেড়টার দিকে ওই ভাস্কর্যটির ভাস্কর মৃণাল হক সুপ্রিমকোর্টের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাংবাদিকদের বলেন, কর্তৃপক্ষ তাকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিতে বলেছে। আগামীতে এনএক্স ভবনের সামনে ভাস্কর্যটি বসানো হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।

কেন সরিয়ে নেয়া হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের ও জনগণের শান্তির জন্য অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়। এ ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়াও তেমনি একটি কাজ। তিনি বলেন, অনেকে এটিকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য বলে মনে করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এটি শাড়ি-ব্লাউজ পরা একটি বাঙালি নারীর ভাস্কর্য।

মৃণাল হকের শিল্পকর্মটি মাটির নিচ থেকে তুলে আনা হবে। মতিঝিলের পূর্বাণী হোটেলের সামনে বলাকা ভাস্কর্য, বিমানবন্দরের সামনে লালন ভাস্কর্য, শেরাটনের সামনে ঘোড়ারগাড়ি নিজ খরচে তৈরি করেছেন তিনি। এর মধ্যে লালন ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মৃণাল হক বলেন, আমেরিকায় আমি রাজকীয়ভাবে ছিলাম। নিউইয়র্ক সিটির বিউটিফিকেশনের দায়িত্বে ছিলাম। আমি সব ফেলে দিয়ে নিজের দেশে এসেছি। আমরা খালি দেশকে মুখে ভালোবাসি। আর আমি প্র্যাক্টিক্যালি ভালোবাসি। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে গেছে, তবু আমি দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাই।

তিনি আরও বলেন, আমি ঢাকা শহরে ২৫টির মতো শিল্পকর্ম করি। অনেকে এগুলো নিয়ে ক্রিটিসাইজ করে। যারা ক্রিটিসাইজ করে তারা তো ভালো কাজ জানে। তাহলে তারা কেন কাজ করে না? তারা কেন ঢাকা শহরে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কাজ করেন না। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আমার গড়া ভাস্কর্যের ওপর হামলা হয়েছে। এগুলো বলতে গেলে তো বিপদ।

গত ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমীর শাহ আহমদ শফী নেতৃত্বাধীন এক দল ওলামার সঙ্গে গণভবনে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর্যটি সরাতে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন।এ মূর্তি অপসারনের বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর কথা হয়। রোজা শুরুর আগে এ ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিল ইসলামী সংগঠনগুলো ।

বছরের ফেব্রুয়ারিতে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী এক বিবৃতিতে বলেন, সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সামনে গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন বাংলাদেশের গণমানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আদর্শিক চেতনার একেবারেই বিপরীত। অবিলম্বে এটি অপসারণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যথায় ইমান, আকিদা ও ঐতিহ্য রক্ষায় লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে।