ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ইতিহাসের পাতায় ভালুকা এস্টেট জামিদারবাড়ি
বৃহত্তর ময়মনসিংহের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বর্ণখনি গৌরীপুর উপজেলায়। এই উপজেলার ১২টি জমিদারবাড়ির মধ্যে গৌরীপুর শহরের উত্তর দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভালুকা এস্টেট বা ভালুকা জমিদারবাড়ি। ভালুকা নামকরণ নিয়ে স্থানীয় লোকদের মধ্যে অনেকের যুক্তি খন্ডন হয়েছে যে, তারা সঠিক ইতিহাস জানে না।
রেনেলের মানচিত্রের তথ্য অনুযায়ী দুই বা আড়াই শত বছর আগে গৌরীপুরে একটি নদীবহুল এলাকা ছিল। ভালকি নদীর উত্তর পাড়ে ছিল ভালুকা। এতে মনে হয়, এই ভালকি নদীর চর থেকে ভালুকা গ্রামের নামকরণ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে (২০২৪) ভালকি নদী একটি বিলের নাম। ভালকি বিলের দুই ধারে এখনও শত শত পুকুর রয়েছে। তাছাড়া গৌরীপুর পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডে দুটি এলাকা রয়েছে- পশ্চিম ভালুকা এবং পূর্ব ভালুকা।
রেনেলের মানচিত্রে গৌরীপুর শহরের পূর্ব দিকে একটি বড় নদী এখন রূপকথার গল্প:
আড়াইশ’ বছর আগের রেনেলের মানচিত্র দেখে মনে হচ্ছে একটি নামবিহীন বড় নদী কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি হতে গৌরীপুরের শাহগঞ্জ বাজার, তাজপুর ও ভূটিয়ারকোনার মধ্যদিয়ে এবং শহরের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শ্যামগঞ্জ বাজারের কাছে সোহাই নদীতে মিলিত হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এ নদীর অনেক শাখা নদী থাকা কারণে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছিল।
তাই রেনেলের মানচিত্রে এই নদীর চিত্র দেওয়া হয়েছে কিন্তু নামগুলো দেওয়া হয়নি।
কলতাপাড়া হয়ে বালুয়া নদী এক সময় গৌরীপুর শহরের মধ্যদিয়ে দুই দিকে প্রবাহিত ছিল। কাইড়া নদীর সাথে ভালকি নদীর সংযোগ এবং বায়রাউড়া গ্রামে ভালকি নদীর সাথে লন্ডনি নদীর সংযোগস্থল ছিল। এই নদীগুলোর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। নদীপথ ব্যবহার করে ইউরোপীয় বণিক, সওদাগর এমনকি নৌবহরসহ রাজা-জমিদাররা ভ্রমণ করতেন বিভিন্ন স্থানে। তখন কোন কোন নদীর প্রশস্ততা ছিল এক থেকে দুই-তিন কিলোমিটারের মতো। নদীর গভীরতা ছিল একশ’ ফুটের অধিক। তাই এক সময় বড় বড় নৌকা এমনকি ছোট ছোট জাহাজ বা স্টিমার চলতো।
কালীপুর ছোটতরফ জমিদারবাড়ি থেকে ভালুকা জমিদারির উৎপত্তি:
ভালুকা এস্টেট জামিদারবাড়ি প্রথম জমিদার কৈলাস চন্দ্র সান্যাল। গৌরীপুর উপজেলার অধীনস্থ কালীপুরের ছোটতরফ জমিদার তারিণীকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী তার একমাত্র মেয়ে শিবসুন্দরী দেবীকে গোবিন্দপুর নিবাসী কৈলাস চন্দ্র সান্যালের সঙ্গে বিয়ে দেন। তারিণীকান্ত লাহিড়ী তার মেয়ে ও জামাইয়ের ভরণপোষণের জন্য প্রচুর অর্থ ও উপযুক্ত তালুক দিয়ে গৌরীপুর শহরের উত্তরের দিকে ভালুকা এলাকায় বাসস্থান করে দেন। তখন থেকে এটি ভালুকা এস্টেট জমিদারবাড়ি নামে পরিচিত হয়।
মেয়ে শিবসুন্দরী দেবীর গর্ভে কোনও সন্তান জন্ম না হওয়ায় দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যালকে দত্তক নেন। জমিদার দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল জয়দুর্গা দেবীর মেয়ে রাজলক্ষ্মী দেবীকে বিয়ে করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যালের স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবীর গর্ভে জ্ঞানেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ ও ফণীন্দ্রনাথ নামে তিন ছেলে এবং চারুবালা নামে এক মেয়ে জন্মে। শিবসুন্দরী দেবীর পিতা কালীপুরের ছোটতরফ জমিদার তারিণীকান্ত লাহিড়ী ১৮৮৪ সালে (বাংলা ১২৯১ সালের ১০ পৌষ) পরলোক গমন করেন।
গৌরীপুর পৌরসভার চেয়াম্যান জমিদার জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যাল:
১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত গৌরীপুর পৌরসভা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার অন্তর্গত ‘ক’ শ্রেণির একটি পৌরসভা। গৌরীপুরের ভালুকা এস্টেট জমিদার জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যাল ছিলেন গৌরীপুর পৌরসভার চেয়াম্যান।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যালরে পারিবারিক বিবরণ:
গৌরীপুরের ভালুকা এস্টেটের জমিদার দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল তার তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে দেবেন্দ্রনাথ সান্যাল ও ফণীন্দ্রনাথ সান্যাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও তার বড় ছেলে জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যাল সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। কালের পরিক্রমায় ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল ও তার দুই ছেলেসহ সকলেই ভারতে চলে গেলেও এক ছেলে জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যাল গৌরীপুরেই থেকে যান। এ জমিদার বংশের অন্যতম প্রাণপুরুষ জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যাল একজন জ্ঞানী, বিদ্যানুরাগী ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যাল ১৯৪৫ সালের ৭ মে হতে ১৯৪৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গৌরীপুর পৌরসভার চেয়াম্যান ছিলেন।
বর্তমান ভালুকা এস্টেট জামিদারবাড়ির বিবরণ:
পরিতাপের বিষয়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাবুর স্মৃতিমাখা রাজবাড়িটি এখন আর নেই। আছে শুধু দুটি পুকুর, ওয়াশরুম, অন্দরমহলের গেইট ইত্যাদি। তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায় – জমিদারবাড়ির বাগান, দুটি পুকুর, ভিটা এখনো সেই স্মৃতি বহণ করে চলছে। ভালুকা এস্টেট জমিদারদের ইতিহাস ঐতিহ্য উপলব্ধি করতে আসলে গৌরীপুর রেলওয়ে জংশনরে কাছেই বাড়িটি অবস্থান অর্থাৎ গৌরীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পথে সাবেক স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী নূরুল আমীন খান পাঠান সাহেবের বাড়িটি হচ্ছে ভালুকা এস্টেট জমিদার বাড়ি।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যালের বার্ধক্যাবস্থা ও মৃত্যু:
ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাফেয়ার্স-এর যৌথ উদ্যোগে মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগনার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য ২০২০ হতে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমান প্রজন্ম জমিদারির সঠিক ইতিহাস কেউ জানে না। ২০২৩ সালে গৌরীপুরের ঐতিহাসিক ভালুকা এলাকায় জরিপের সময় এলাকার কয়েকজন বাসিন্দাসহ প্রবীন ব্যক্তিদের সঙ্গে ভালুকা এস্টেট জমিদারি বিষয়ে কথা হয়। পুরাতন জেলাখানা মোড়ের বাসিন্দা মোঃ মমতাজ উদ্দিন (৮৫) বলেন, জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যালের স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী সকলেই কলকাতায় বসবাস করতেন।
শুধু জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যাল গৌরীপুরের ভালুকা রাজ প্রাসাদে থাকতেন।পাকিস্তান আমলে (১৯৬৯-৭০ সালে) গৌরীপুরের ভালুকা এলাকায় একটি সাইকেল দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় অথবা কলকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
মোঃ মমতাজ উদ্দিন (৮৫) আরও বলেন যে, পরবর্তীতে গৌরীপুর সরকারি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মেজবাহ উদ্দিনের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী নূরুল আমীন খান পাঠান ওই জমিদার বাড়ির দলিল তৈরি করে মৃত জ্ঞানেন্দ্রনাথ সান্যালের ছেলের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে মালিকানা দাবি করে প্রকাশ করেন এবং ২০০০ সালে মূল জমিদারবাড়িটি ভেঙ্গে একটি আধুনিক বাড়ি নির্মাণ করেন। নূরুল আমীন খান পাঠান ৭ সেপ্টেম্বর ২০০০ সালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গৌরীপুর পৌর শহরে ভালুকার বাসায় মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র:
১. ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার— শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (রামগোপালপুর এস্টেট এর জমিদার ও রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ৩য় পুত্র)
২. ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ— শ্রী কেদারনাথ মজুমদার
৩. ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব— মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা
৪. ব্রিটিশ ভূবিদ মেজর জেমস রেনেলের অংকিত কয়েকটি মানচিত্র
৫. উইকিপিডিয়ার উল্লেখিত শিরোনামগুলো থেকে (ক) সাবেক স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী নূরুল আমীন খান পাঠান – উইকিপিডিয়া
৬. ম্যাগাজিন: পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০, পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২১ ও ২০২২
৭. ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন কর্তৃক প্রতিবেদন (এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স )
(৮) A Description Of The Roads In Bengal And Bahar and A General Map of the Roads in Bengal
(৯) David Rumsey Historical Map Collection. (18) New York Historical Society.
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন