মানিকগঞ্জের সিংগাইরে এক মূর্তিমান আতংক জাবি‘র নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক আনন জামান

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনন জামান। গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের গোলাইডাঙ্গা গ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খ্যাতি, যশ অর্জনের সাথে তিনি আনন জামান নামে পরিচিতি পেলেও তার ডাক নাম নূরু ওরফে নুরুজ্জামান। নিজ গ্রামে তাকে এ নামেই চিনে।

আওয়ামীলীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সাংস্কৃতিক অঙ্গণে দাপটের সাথে পদচারণা ছিল আনন জামানের। শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। আওয়ামী রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে হয়েছেন সিংগাইর উপজেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা। তার নিজ বাড়ি গোলাইডাঙ্গায় আগমন ঘটেছে আওয়ামীলীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, দলের প্রভাবশালী নেতা, নাট্য ব্যক্তিত্ত্ব ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের। বাড়িতে তার মা ও বাবার নামে তসলিমা-জালাল মঞ্চে সাংস্কৃতিক চর্চার নামে উঠতি বয়সের যুবক-যুবতী নিয়ে রাতভর চলতো মাদকের আড্ডা ও অসামাজিক কার্যকলাপ।

আওয়ামীলীগ সরকারের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আনন জামানের বিরুদ্ধে এলাকায় জমিদখলসহ সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম অত্যাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এতোদিন ভূক্তভোগীরা মুখ খূলতে সাহস না পেলেও গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। স্থানীয় অনেকে নানা অভিযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে আসছেন।

সম্প্রতি আনন জামানের বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এমন অনেক অভিযোগ তুলে ধরা হয়। ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সংবাদকর্মীরা মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন গোলাইডাঙ্গা গ্রামে ভুক্তভোগী অনেকেই আনন জামানের বিরুদ্ধে জুলুম অত্যাচারের বর্ননা করেন।
গোলাইডাঙ্গা বাজারের ইসলাম ষ্টীল কিং এর স্বত্ত্বাধিকারী আমিনুর রহমান বলেন,ফার্নিচার বাবদ আনন জামানের কাছে ১ লাখ দু’হাজার টাকা পাই।

টাকা চাইলে না দিয়ে কোর্টে বা থানায় কোনো কাজ থাকলে তদবির করে দেয়ার আশ্বাস দেন তিনি। এলাকায় উনার একটা নিজস্ব বাহিনী আছে যার জন্য কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। তা ছাড়া উনার বাড়িতে প্রায় রাতে ওই বাহিনীর সদস্যরা নেশা করে রাতভর নারী নিয়ে আনন্দে মেতে উঠতো।

আরেক অভিযোগকারী ফার্নিচার ব্যবসায়ী স্থানীয় ফরিদ হোসেন বলেন,আনন জামানের কাছে আমি কাজের মজুরি বাবদ ৩৫ হাজার টাকা পাই। দেই দিচ্ছি বলে ঘুরাতে থাকেন একপর্যায়ে লস প্রজেক্টের কথা বলে টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, তার বড় ভাই আব্দুস সোবহান আমার অনুপস্থিতিতে ফার্নিচার দোকান থেকে ১২-১৩ জন লোক নিয়ে জোরপূর্বক মিস্ত্রির কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা মূল্যের খাট নিয়ে গেছে। টাকা চাইলে উল্টো খুন-জখমের হুমকি দেয় ম। গরীব মানুষ বলে আমাদের কিছুই করার নেই।

স্থানীয় নজরুল ইসলাম বাদশাহর ছেলে বিজয় (৩৮) বলেন,আনন জামানের লোকজন আমাদের বাড়ির সামনে মাদক বিক্রি করত। আমি নিষেধ করলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আমাকে গুম করে ফেলার হুমকি দেয়। গোলাইডাঙ্গা বাজার কমিটির সভাপতি ও রুপা ষ্টোরের মালিক বাদশাহ মিয়া বলেন, ইতিপূর্বে ওনার বাড়িতে গান-বাজনায় দোকানদারদের কাছে চাঁদা দাবী করেন। দিতে অস্বীকৃতি জানালে ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেন।

এতে আমরা সমস্ত দোকানপাট বন্ধ করে দেই। পরে পুলিশি হস্তক্ষেপে মিমাংসা হয়। বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী এখনো ওনার কাছে টাকা পাবেন বলেও তিনি জানান। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা গেছে, গোলাইডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের জমি দখল করে হাকিম আলী গায়েন থিয়েটার ও স্কুল মার্কেটের দোকানপাট থেকে ভাড়া তুলতেন তিনি।

এদিকে, তার বাড়িতে সাংস্কৃতিক চর্চার নামে তসলিমা-জালাল মঞ্চে মাদকের আড্ডা ও অসামাজিক কার্যকলাপে ভিআইপিদের আগমন ঘটত রাতে। মনোরঞ্জন শেষে ভোর হলেই তারা বিদায় নিতেন। তার এ মঞ্চে সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী দিপু মনি,সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান , সাবেক সংসদ সদস্য কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম, ডিআইজি হাবিব ছাড়াও নামি দামি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সমাগম ঘটত অহরহ।

এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব বাহিনী। বাহিনীর সদস্য রাখাল সবুজ, দুলাল,নিশিথ শামীম, ওভিদ আনোয়ার, নাঈমুর রহমান ও ইমন কল্যানসহ অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। আর এদের দাপটেই আনন জামান এলাকায় সাধারণ মানুষের ওপর দমন-পীড়নের রাম রাজত্ব কায়েম করেছেন।

গোলাইডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আমিনুর রহমান স্কুলের জমিতে ঘর নির্মাণ ও মার্কেটের দোকানপাট থেকে আনন জামানের ভাড়া তোলার কথা স্বীকার করে বলেন, ঘরের বিষয়ে ম্যানেজিং কমিটি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ ছাড়া মার্কেট এখন আনন জামানের হাত থেকে মুক্ত, স্কুলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনন জামানের সঙ্গে এশাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি ঘুমে থাকায় তার স্ত্রী চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাকিলা তাসলিম বলেন, আমরা নিরিবিলি একটা পরিবার। তার ধ্যান-জ্ঞান সব গ্রামের বাড়ির দিকে।

এলাকার লোকজনের বিনোদন ও আনন্দ ফূর্তির জন্য বছরে একটা মেলা করা হয়।তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো সত্য নয়।

সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পলাশ কুমার বসুর কছে এসব বিষয় জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মানিকগঞ্জ জেলা কালচারাল অফিসার সেলিনা সাইয়্যেদা সুলতানা আক্তার বলেন, কালচারাল প্রোগ্রামের বিষয়টি একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। আমার জানামতে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের আওতায় হাকিম আলী গায়েন ও নিরাভরণ থিয়েটার আনন জামান স্যারের নিজের করা।