মার্কিন শ্রমনীতির লক্ষ্যবস্তু বাংলাদেশ
শ্রম ইস্যুতে সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ মিশন। গত ২০ নভেম্বর দূতাবাসের মিনিস্টার (বাণিজ্য) মো. সেলিম রেজা স্বাক্ষরিত চিঠিতে এমন আভাস দেওয়া হয়। তবে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশটির শ্রমনীতি বৈশ্বিক। এখানে বাংলাদেশের উদ্বেগের কারণ নেই।
গত ১০ বছরে তিনবার শ্রমনীতি সংশোধন হয়েছে। শ্রমবিধি হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক ইস্যুতে শ্রমিকদের ক্ষতি হয়, এমন উদ্যোগ নেবে না যুক্তরাষ্ট্র। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে তারাই কথা বলছে।
শ্রম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রম অধিকারের ঘাটতি আছে বলেই পুলিশ দিয়ে শ্রমিকদের দমন করা হয়। মজুরি নিয়ে আন্দোলন করলে হাজার হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
২০ নভেম্বর দূতাবাসের মিনিস্টার (বাণিজ্য) মো. সেলিম রেজা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইস্যু করা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের ঘোষণা দেওয়া ‘মেমোরেন্ডাম অন অ্যাডভান্সিং ওয়ার্কার এমপাওয়ারমেন্ট, রাইটস অ্যান্ড হাই লেবার স্ট্যান্ডার্ডস গ্লোবালি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি বিবেচনার জন্য একই সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হলো। যদিও এটি বিশ্বের সব দেশের ওপরই প্রযোজ্য বলে মনে হচ্ছে, তবু বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে এর অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে বাংলাদেশ।
প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডাম হলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নির্বাহী শাখার অধীনে বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার কর্ম, অনুশীলন ও নীতিগুলো পরিচালনা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জারি করা এক ধরনের নির্দেশ।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতি নিয়ে আমাদের শঙ্কা নেই। তারা যেখানে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে, সেখানে বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো কিছু করবে না বলে আমাদের প্রত্যাশা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধাও পায় না বাংলাদেশ।’ তিনি বলেন, শ্রম অধিকার নিয়ে বাংলাদেশ গত ১০ বছরে অনেক এগিয়েছে।
এর মধ্যে তিনবার শ্রম আইন সংশোধন হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেন, বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি ঋণাত্মক হলেও অন্য দেশে ক্রয়াদেশ স্থানান্তর হচ্ছে, এমনটা নয়। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতায় কোনো কোনো ক্রেতা ক্রয়াদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত করছেন।
নতুন মজুরি ঘোষণার পর পোশাকের দর বাড়ানো নিয়ে ক্রেতাদের ইতিবাচক সাড়া আছে বলে জানান ফারুক হাসান। তিনি বলেন, এরই মধ্যে বিশ্বের বড় ক্রেতা ও ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়া দিতে শুরু করেছে। এর মধ্যে এইচ অ্যান্ড এম, অ্যালকট এবং ডেনমার্কের বেস্ট সেলার দাম বাড়ানোর ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বড় পোশাক রপ্তানিকারক ট্রেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, ‘এই শ্রমনীতি বৈশ্বিক, এখন শঙ্কার কিছু নেই। তবে সতর্ক থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাউজার রপ্তানি করি আমরা। গত এক বছরে আমাদের রপ্তানি কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। গড়ে সব বজারে কমেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।’
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি নিয়ে জানতে চাইলে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় কর্মরত সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ার শ্রম কার্যক্রমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ (স্পেশালিস্ট অন ওয়ার্কার অ্যাক্টিভিটিজ) সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, শ্রমনীতি নিয়ে চাপে না থেকে দেশে শ্রম অধিকার নিয়ে যেসব ঘাটতি রয়েছে, সেখানে গুরুত্ব দিতে হবে উদ্যোক্তাদের। এসব ঘাটতি পূরণে মালিক ও সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। বিশেষ করে কারখানাগুলোতে শ্রমিক সংঘ (ট্রেড ইউনিয়ন) করার (পকেট ইউনিয়ন নয়) পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তদারক করা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের শ্রমিকদের অধিকারের ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ দিয়ে শ্রমিক দমন করা যাবে না। তারা শান্তিতে থাকলে তো আর মাঠে নামে না। এ ছাড়া সম্প্রতি মজুরি আন্দোলনে চার শ্রমিক নিহত হওয়া এবং ১৮ হাজার শ্রমিকের নামে মামলাই বলে দেয় যে শ্রমিক অধিকারের ঘাটতি রয়েছে। সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, যখন কোনো দেশে কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার বিষয়ে দুর্বলতা থাকে, তখন সেখানে বাইরের কেউ এসে কথা বলার সুযোগ পায়। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে নিজেদের দুর্বলতা নিজেদেরই দূর করতে হবে।
বহির্বিশ্বে শ্রমিক আন্দোলন ভালো কোনো বার্তা দিচ্ছে না বলে মনে করেন সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি নিয়ে পোশাকশিল্পের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ও শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করেন, এমন ব্যক্তিরা বলছেন, সরকার বা পোশাক মালিকদের দিক থেকে যতই বলা হোক, এ দেশে শ্রমিকদের কথা বলার অধিকার আছে, শ্রম পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, বাস্তবতা ভিন্ন।
এ প্রসঙ্গে নিট পোশাক খাতের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি নিয়ে আমাদের আশঙ্কার কিছু নেই। তারা বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে নিলে আমাদের করার কিছুই নেই। তবে বড় বাজারগুলোতে পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় বর্তমানে ক্রয়াদেশ কম। ফলে সক্ষমতার ৪০ শতাংশ নিয়ে চালু আছে কারখানাগুলো। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটও উদ্যোক্তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে গ্যাসসংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন