মুর্তজার মৃত্যুদণ্ড ঠেকাতে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিশ্ব
প্রবল সর্বাত্মকবাদী ও দমনমূলক সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাত্র ১০ বছর বয়সে সোচ্চার হয়েছিল মুর্তজা কুরেইরিস। আরব বসন্তের ঢেউ এসে নাড়া দিয়েছিল তার চৈতন্যে। ২০১১ সালে অহিংস প্রতিবাদী এক সাইকেল মিছিল থেকে মুর্তজা দাবি করে বসেছিল ‘মানবাধিকার’। সেই অপরাধের প্রহসনের বিচার শেষে সদ্য ১৮তে পা রাখা সেই মুর্তজার ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় সৌদি আরব। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে বিশ্বজুড়ে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই সৌদি পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। রিয়াদকে এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সিদ্ধান্ত থেকে বের করে আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছে তারা। তার ফাঁসি কার্যকর হলে সৌদি আরবের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ১৮ বছর বয়সী মুর্তজার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে তা হবে বিশ্বের শিশুদের আইনি সুরক্ষার সবথেকে ভয়াবহ লঙ্ঘনের ঘটনা।
আরবের দুর্নীতিপ্রবণ ও জনবিরোধী শাসকদের বিরুদ্ধে যখন বসন্তের ঢেউ খেলে গিয়েছিল, সে সময় সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল ১০ বছর বয়সী শিশু মুর্তজা কুরেইরিস। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় সাইকেল নিয়ে অহিংস প্রতিবাদে নেমেছিল সে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন সম্প্রতি তাদের এক বিশেষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানতে সক্ষম হয়, সুদীর্ঘ নিপীড়ন ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তার মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। সবশেষে শান্তিপূর্ণ সরকারবিরোধিতার শাস্তি হিসেবে ওই শিশুর মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষিত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, তাকে ‘বিচারিক হত্যা’র বলি বানানোর অপেক্ষায় রয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। রিপ্রাইভ নামের মানবাধিকার সংগঠনের পরিচালক মায়া ফোয়া বলছেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শিশুদের ফাঁসিতে ঝোলানোর থেকে বড় অপরাধ তেমন একটা নেই।’ তিনি বলেন, ১৮ বছর বয়সী মুর্তজা কুরেইরিসের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে সারা বিশ্ব থেকে তাদের দায়মুক্তি বিজ্ঞাপিত করছে।
মুর্তজাকে গ্রেফতার দেখানো হয় ২০১৪ সালে, যখন তার বয়স ১৪। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় ২০১১ সালের ঘটনায়, যখন তার বয়স ছিল ১০। সরকারবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দেওয়া, আগ্নেয়াস্ত্র রাখা ও সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলা হয় তার বিরুদ্ধে। একটি মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় সৌদি সংগঠন মুর্তজার মামলার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে তারা জানিয়েছে, ২০১৮ সালের আগস্টে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে মুর্তজার ফাঁসির সুপারিশ করেছে প্রসিকিউশন। তারা জানায়, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে তাকে নির্জন কক্ষে আটক রাখা হয়। কোনও আইনজীবীর সঙ্গে তাকে দেখাও করতে দেওয়া হয়নি।
নেদারল্যান্ডসভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফ্রিডম অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মানবাধিকারের দাবিতে ১০ বছর বয়সে সাইকেল র্যালির মাধ্যমে প্রতিবাদে নেমেছিল মুর্তজা। ৩ বছর পর তাকে আটক করা হয়। সৌদি আরবের প্রতি ওই সংগঠনের আহ্বান: ‘সরকারবিরোধিতার কারণে ১৩ বছর বয়সে আটক হওয়া শিশুকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন না’।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, ২০১৮ সালের আগস্টে মুর্তজার ফাঁসির সুপারিশ করা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড সৌদি আরবের জন্য নতুন কিছু নয়। প্রায়শই তা কার্যকর করা হয় শিরশ্ছেদের মধ্য দিয়ে। সুদীর্ঘ দিন আটক রাখা, নিপীড়নের মধ্য দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় আর প্রহসনের বিচারকার্যের মধ্য দিয়ে দণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে শিশু অবস্থায় করা কোনও কথিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা সেখানেও বিরল, যা মুর্তজার ক্ষেত্রে ঘটতে যাচ্ছে।
২০১৭ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মৃত্যুদণ্ড সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সৌদি আরব জানায়, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে কেবল ভয়াবহ গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং দোষীদের আত্মপক্ষ সমর্থনে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হয়। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, ছোটখাট অপরাধেই মৃত্যুদণ্ড দেয় সৌদি আরব, এবং দেশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে মৃত্যুদণ্ডকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সেখানকার রাজতান্ত্রিক শাসকরা।
অ্যামনেস্টির মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা বিভাগের পরিচালক লিন মালৌফ বলেন, ‘নাগরিকদের বিক্ষোভকে দমন করার জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ। এমনকি নিতান্তই শিশুদেরও গ্রেপ্তার করে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে সৌদি প্রশাসন।’
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মুর্তজাকে গ্রেপ্তার করে আল-দাম্মামের একটি কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে রাখা হয়। এক মাস তাকে সেখানে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। মুর্তজাকে মিথ্যা প্রলোভন দেখানো হয়, যদি সে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেয়, তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি সৌদি সরকার। মুর্তজার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো হলো ‘রাজ্যবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়া, জঙ্গি সংগঠনে অংশ নেওয়া বড় ভাইয়ের জানাজায় অংশ নেওয়া, পুলিশ স্টেশনে ককটেল বোমা ছুড়ে মারা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি করা।
শিয়া সংখ্যালঘুদের প্রতি সৌদি সরকারের বৈষম্যের প্রতিবাদে বিভিন্ন সময়ে এসব বিক্ষোভ করা হয়। অ্যামনেস্টি জানায়, যেকোনো ধরনের প্রশাসনবিরোধী কর্মকাণ্ড, বিক্ষোভ কঠোর হাতে দমন করে সৌদি আরব প্রশাসন। মৃত্যুদণ্ড এ ধরনের বিক্ষোভ দমনের অন্যতম হাতিয়ার। অ্যামনেস্টির মালৌফ বলেন, ‘সৌদি আরবের মৃত্যুদণ্ডকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর একজোট হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন