ধাক্কা খাওয়ার শঙ্কায় কোম্পানিগুলো
মোটরসাইকেলে লাগবে না বীমা!
পরিবহনের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা তুলে দিয়েছে সরকার। ফলে এখন থেকে বীমা ছাড়াই মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের যানবাহন চালানো যাবে। পরিবহনের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা তুলে দেয়ার কারণে দেশে ব্যবসা করা সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের যে বীমা করা হয় তার প্রায় সবটাই তৃতীয় পক্ষের বীমা। গণপরিবহনের বীমা করা হয় তৃতীয় পক্ষের। প্রাইভেটকারের কিছু বীমা প্রথম পক্ষের করা হলেও বেশিরভাগ করা হয় তৃতীয় পক্ষের। সুতরাং তৃতীয় পক্ষের বীমা তুলে দেয়ার কারণে মোটর বীমা থেকে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো যে আয় হতো তার প্রায় পুরোটাই হারাতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, বছরে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো যে প্রিমিয়াম আয় করে তার ১০ শতাংশই আসে মোটর বীমা থেকে। এর মধ্যে বড় অংশই আসে মোটরসাইকেল থেকে। এর প্রায় সম্পূর্ণ অংশ তৃতীয় পক্ষের হওয়ায় এসব বীমার পক্ষে কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধনের পরিমাণও বেশ কম। ফলে মোটর বীমার প্রায় সম্পূর্ণ অংশই কোম্পানিগুলোর আয় হয়। এখন তৃতীয় পক্ষের বীমা তুলে দেয়ায় কোম্পানিগুলো এই প্রিমিয়াম আয় হারাবে।
মোটর বীমার প্রিমিয়াম আয় হারানোর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, তৃতীয় পক্ষের বীমা তুলে দেয়ার কারণে এখন প্রথম পক্ষের বীমা থাকছে। আর প্রথম পক্ষের বীমা বাধ্যতামূলক নয়। অপরদিকে প্রথম পক্ষের বীমার প্রিমিয়াম হার অত্যন্ত বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মোটরযানের মালিকরা বীমা করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ধারা ১০৯ অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাধ্যতামূলক ছিল এবং এর অধীনে ১৫৫ ধারায় দণ্ডের বিধানও ছিল। তবে নতুন সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে তৃতীয় পক্ষের বীমা তুলে দেয়া হয়েছে।
আইনের এ বিষয় তুলে ধরে সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা না থাকলে সংশ্লিষ্ট মোটরযান বা মোটরযানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো সুযোগ নেই। বিআরটিএ’র এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি পুলিশ মহাপরিদর্শক, সব মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, হাইওয়ে পুলিশপ্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
বীমা কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, মোটরযানের বীমা করতে হলে নিবন্ধিত হওয়া বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ যে মোটরযানগুলোর বীমা করা হয় তার সবই নিবন্ধিত। ২০১৮ সালে মোটরযান বীমা করে দেশে ব্যবসা করা সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো ৩৮২ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার প্রিমিয়াম আয় করে, যা কোম্পানিগুলোর মোট প্রিমিয়াম আয়ের ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। বছরটিতে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো মোট প্রিমিয়াম আয় করে চার হাজার ১৭৯ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
অবশ্য একটা সময় মোটরযান বীমা থেকে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ প্রিমিয়াম আয় করতো। তবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয়ে মোটরযান বীমার হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
এদিকে বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত মোটরযান আছে ৪৫ লাখ ২৩ হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৫৫৯টি। চলতি বছরে (আগস্ট পর্যন্ত) এক লাখ ৭৯ হাজার ১৪০টি মোটরসাইকেলসহ নতুন মোটরযান নিবন্ধিত হয়েছে মোট দুই লাখ ২১ হাজার ৯৯০টি। বিআরটিএ’র নতুন নির্দেশনার আগে এসব নিবন্ধিত মোটরযানের জন্য তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাধ্যতামূলক ছিল। এখন এসব মোটরযানের জন্য কোনো বীমাই বাধ্যতামূলক নয়।
বিআরটিএ’র পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মো. লোকমান হোসেন মোল্লা বলেন, আইনে তৃতীয় পক্ষের বীমা তুলে দেয়া হয়েছে। এখন শুধু প্রথম পক্ষের বীমা আছে। প্রথম পক্ষের বীমা সব দেশেই অপশনাল (ঐচ্ছিক)। অর্থাৎ এটি বাধ্যতামূলক নয়। সুতরাং মালিক চাইলে তার পরিবহনের বীমা করতে পারেন, না করলেও সমস্যা নেই।
সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জাহিদ আনোয়ার খান বলেন, আমরা সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে বৈঠক করেছিলাম সেখানেও বলা হয়েছিল, তৃতীয় পক্ষের বীমা তুলে দিয়ে কম্প্রিহেনসিভ (ব্যাপক) বীমা বাধ্যতামূলক করার। কিন্তু এখন আইনে পরিবহন বীমার ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের বীমা তুলে দিলেও কম্প্রিহেনসিভ বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। সুতরাং পরিবহনের ক্ষেত্রে এখন বীমা করা বাধ্যতামূলক নয়।
তিনি বলেন, তৃতীয় পক্ষের বীমা তুলে দেয়ার কারণে এখন সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ বাংলাদেশে যে মোটর বীমা হয় তার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ তৃতীয় পক্ষের বীমা। স্বল্প প্রিমিয়াম দিয়ে তৃতীয় পক্ষের বীমা করা যেত। অপরদিকে প্রথম পক্ষের বীমা করতে মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম দিতে হয়। সুতরাং পরিবহনের ক্ষেত্রে বীমা বাধ্যতামূলক না থাকায় গ্রাহকরা এখন বীমা করতে উৎসাহী হবেন না।
পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের উপদেষ্টা কিউ এ এফ এম সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, আমাদের দেশে মোটরসাইকেলের যে বীমা হয় তার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ তৃতীয় পক্ষের। প্রাইভেটকার, বাস, মিনিবাস, ট্রাকসহ অন্যান্য পরিবহনের বেশিরভাগ বীমা তৃতীয় পক্ষের। কম্প্রিহেনসিভ বা প্রথম পক্ষের বীমা খুবই কম। এর কারণ হলো কম্প্রিহেনসিভ বীমার প্রিমিয়াম হার অত্যন্ত বেশি। আমি মনে করি, কম্প্রিহেনসিভ বীমার প্রিমিয়াম হার কমানো উচিত।
তিনি বলেন, আমার যে গাড়ি আছে, তার তৃতীয় পক্ষের বীমা আগে সাড়ে ৫০০ টাকার মধ্যে হয়ে যেত। এখন সেই গাড়ির কম্প্রিহেনসিভ বীমা করতে ৪২ হাজার টাকার মতো লেগেছে। এত টাকা দিয়ে কে বীমা করবে?
একইভাবে একটি মোটরসাইকেলের তৃতীয় পক্ষের বীমা করতে ২২৫ টাকা লাগে। কম্প্রিহেনসিভ বীমা করতে এক লাখ টাকা দামের মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে লাগবে আড়াই হাজার টাকার মতো। মোটরসাইকেলের দাম বেশি হলে বীমার প্রিমিয়াম হারও বেশি হবে—বলেন এই সাধারণ বীমা বিশেষজ্ঞ।
নতুন সড়ক পরিবহন আইনে বীমার বিষয়ে কী আছে
মোটরযানের বীমার বিষয়ে নতুন আইনের ধারা ৬০ এর উপধারা (১) (২) ও (৩)-এ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই তিন উপধারায় বলা হয়েছে-
>>> যে কোনো মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করলে তার মালিকানাধীন যে কোনো মোটরযানের জন্য যে সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট করা, তাদের জীবন ও সম্পদের বীমা করতে পারবে।
>>> মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠানের অধীন পরিচালিত মোটরযানের জন্য যথানিয়মে বীমা করবেন এবং মোটরযানের ক্ষতি বা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি বীমার আওতাভুক্ত থাকবে। বীমাকারী ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী হবেন।
>>> মোটরযান দুর্ঘটনায় পতিত হলে বা নষ্ট হলে ওই মোটরযানের জন্য ধারা ৫৩ এর অধীন গঠিত আর্থিক সহায়তা তহবিল হতে কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাবে না।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন