যানজটে অসুস্থ হচ্ছে মানুষ, খিটখিটে হচ্ছে আচরণ
রাজধানীতে দুঃসহ যানজটের কারণে মানুষ ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে বলে একটি সেমিনারে সতর্ক করা হয়েছে। এতে জানানো হয়, দীর্ঘ সময় সড়কে আটকে থাকায় মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ছে। সেই সঙ্গে মানসিক দিক থেকে চাপে পড়ছে নগরবাসী।
আর এ কারণে মানুষ প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সময় পাচ্ছে না। স্বজন এবং অন্যের সঙ্গে ‘ন্যায্য’ আচরণের বদলে দুর্ব্যবহার করছে ভুক্তভোগীরা।
আবার দুর্ঘটনা আহত বা শঙ্কটাপন্ন রোগীদেরকেও সময় মতো হাসপাতালে নেয়া যাচ্ছে না বলে পথেই মৃত্যু হচ্ছে অনেক মানুষের।
ওই সেমিনারে জানানো হয়, পিক আওয়ারে রাজধানীতে ড়ড়ে গাড়ি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলছে। হেঁটে চললে এই গতিতে কোথাও পৌঁছানো যায়। ঢাকায় পরিবহন সেবা বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বলেও জানানো হয় আলোচনায়।
শনিবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ বিষয়ে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এর আয়োজন করে বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
এই আলোচনায় যানজটের আর্থিক ক্ষতি, মোকাবেলার নানা পরামর্শের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির দিকটি নিয়েও আলোচনা করা হয়।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল) এর সাবেক পরিচালক সিরাজ উল ইসলাম বলেন, ‘যানজটের কারণে সব রোগই হয়। কারণ দেখা যায় একজন যানজটে এসি গাড়িতেও ঘামছে। এটা তার টেনশন। সে চিন্তা করছে, সময় মত পৌঁছাতে পারবে না। এর প্রভাব পরে তার শরীরে।’
‘যানজট জীবনকে জটিল করে দিচ্ছে। থাইল্যান্ডে দেখেছি কেউ অসুস্থ হলে তাকে তিন মিনিটে সেবা দেয়। কিন্তু আমাদের এখানে ৩০০ মিনিটেও সেটা পারা যাবে কি না সন্দেহ আছে।’
গত বছর সারাদেশে সাড়ে ছয় হাজার দুর্ঘটনায় উদ্ধার করা ১১ হাজার ৫০০ জনের মধ্যে আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যুর পেছনেও অন্যতম কারণ হিসেবে যানজট দায়ী বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ঢাকা) দেবাশীষ বর্ধন। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় যানজটের কারণে দ্রুত হাসপাতালে না নিতে পারার কারণেও অনেকে মারা গেছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফারাহ্ দীবা, বলেন, যানজটের কারণে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি-দুটোই হয়।
‘মানসিক যে ক্ষতিটা হয় সেটা হচ্ছে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আর এর প্রভাব পরে তার আচরণে।’
‘দেখা যায় বাসায় আসার পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাগের সঙ্গে কথা বলে। প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সময় পাওয়া যায় না। যেহেতু যানজটে আটকে থাকতে হয় তাকে অনেক সময়।’
পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে
২০১৭ সালে জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়, গত ১০ বছরে ঢাকার যান চলাচলের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে মাত্র সাত কিলোমিটারে এসেছে। ওই হিসাবে প্রতিদিন ঢাকায় নষ্ট হতো ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। সেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে এক বছরে।
মূল প্রবন্ধে এআরআইএর পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এখন প্রতি ঘন্টা কয়টাকা করে হিসেব করবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার।’
যেসব পরামর্শ
আলোচনায় যানজট মোকাবেলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, ‘যানজট নিরসনে সরকারে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে হকারদের পুনর্বাসন করতে হবে। পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে।’
‘ঢাকায় এখন বাস আছে সাড়ে ছয় হাজার যাতে ৩০ লাখ যাত্রী যাতায়াত করে। কিন্তু এটা বড় আকারে বাস আড়াই হাজার দিলেই এই সংখ্যাক যাত্রী পরিবহন সম্ভব। রাজধানীতে মাত্র তিনটি বড় সড়ক আছে। এর সংখ্যা বাড়াতে হবে।’
রাজধানীর উপর চাপ কমাতে নারায়ণগঞ্জ, সাভার, টঙ্গী, গাজীপুরের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ আসে আলোচনায়। অফিস সময়ের আগে ও পরে ১০ মিনিট পরপর এসব রুটে ট্রেন ছাড়লে মানুষ রাজধানীর বদলে লাগোয়া জনপদে বেশি থাকবে বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
মোয়াজ্জেম বলেন, রাজধানীতে মোট জমির যে সাত থেকে আট শতাংশ রাস্তা আছে। সেটারও যদি সঠিক ব্যবহার করা যায় তাহলে যানজটের কারণে ক্ষতি হওয়া ২২ হাজার কোটি টাকা রক্ষা করা যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এ আই মাহবুব উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সরওয়ার জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ প্রমুখ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন