যেভাবে তিন তালাকে জয়ী হলেন ভারতীয় নারীরা
ছয় মাসের জন্য মুসলমানদের মৌখিক তিন তালাক স্থগিতের আদেশ দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে মৌখিক তিন তালাককে অসাংবিধানিক বলেও মন্তব্য করেছেন আদালত। তিন তালাক নিষিদ্ধের আবেদন জানিয়ে করা ভারতীয় তালাকপ্রাপ্ত নারীদের করা পিটিশনের রায়ে মঙ্গলবার দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এ মন্তব্য করেন।
তিন তালাকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে যে নারীরা পিটিশন দায়ের করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন শায়েরা বানু। তিনি আদালতের এই রায়ের পর বলেছেন, ভারতের মুসলিম নারীদের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তরফ থেকেও তিন তালাক বাতিল স্থগিত হওয়ার ঘটনাকে নারীদের বড় জয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি জেএস খেহারের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির একটি বেঞ্চ একটি পিটিশনের শুনানি শেষে মঙ্গলবার এ রায় দিয়েছেন। তবে নারীদের এই জয় খুব সহজ ছিল না। তিন তালাক বাতিলের জন্য নারীদের দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করতে হয়েছে।
শ্বশুর বাড়ি থেকে বের করে দেবে এমন আতঙ্ক আর ভয়ে বছরের পর বছর দিন কাটিয়েছেন ভারতের মুসলিম নারীরা। তিনবার তালাক বলার পর পরই মুসলিম পুরুষরা চাইলেই তাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে পারতেন। এক্ষেত্রে নারীদের কোনো স্বাধীনতা থাকত না। স্বামী তিন তালাক বলার পরপরই শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। এটা মুসলিম নারীদের জন্য খুবই অপমানজনক।
তিন তালাকের শিকার জয়পুর এলাকার আফরিন রেহমান বলেন, আদালতের এই রায়ে আমি খুব খুশি। দেশ থেকে তিন তালাক বাতিলের সূচনা এটি। আমরা তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইন চাই। আর আদালত সরকারকে সেদিকেই পরিচালনা করছে।
তিনি আরো বলেন, আইন না হওয়া পর্যন্ত আদালত তিন তালাক স্থগিত রাখবে। তিন তালাকের নামে নারীদের সঙ্গে যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে, যেভাবে তাদেরকে পায়ের জুতার মতো ঘর থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে সেটা এখন বন্ধ হবে।
অল ইন্ডিয়া ওমেন পারসোনাল ল’ বোর্ডের প্রেসিডেন্ট সেইস্তা আম্বার সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে ভারতের কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে মৌখিকভাবে তিন তালাক দিতে পারবেন না। সরকার এই ছয় মাসের মধ্যেই তিন তালাকের বিরুদ্ধে কোনো আইন আনবেন এটাই আশা করছেন মুসলিম নারীরা।
এক তরফা এই তালাক বাতিলের জন্য গত কয়েক দশক ধরেই প্রচারণা চালানো হচ্ছে। গত বছর তিন তালাকের বিরুদ্ধে পিটিশন দায়ের করেছিলেন দুই সন্তানের জননী ৩৫ বছর বয়সী শায়েরা বানু।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিটিশন দায়ের করেন তিনি। তিনি বলেন, তার স্বামী যখন তাকে তালাক দেন তখন তিনি উত্তরাখন্ডে বাবার বাড়িতে ছিলেন। তালাকনামা পাঠিয়ে তার স্বামী তাকে জানান যে, তিনি আর তার সঙ্গে সংসার করতে চান না। তাই শায়েরা বানুকে ডিভোর্স দিয়েছেন তিনি।
শায়েরা বানু তার পিটিশনে ভারতে তিন তালাক প্রথা পুরোপুরি বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন। কারণ মুসলিম পুরুষরা তিন তালাক প্রথার অপব্যবহার করে মুসলিম নারীদের ইচ্ছা হলেই বাড়ি করে বের করে দিতে পারছে।
শুধু তিন তালাক নয় হিল্লা বিয়ে, বহুবিবাহও বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন শায়েরা বানু। তিনি বলেন, এসব কার্যক্রম নৈতিক, অসাংবিধানিক এবং আধুনিক নীতিগুলোর বিরোধী।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মতে, তিন তালাকের প্রথা কোরআনবিরোধী এবং সে কারণেই এটাকে তারা কিছুতেই ইসলাম-সম্মত বলে মানা যায় না।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত ছয়মাসের জন্য তিন তালাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এই সময়সীমার মধ্যে পার্লামেন্টকে তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করার জন্যও বলেছে।
ইসলামি বিশেজ্ঞরাও বলেছেন যে, তিন তালাক প্রথা অবৈধ। ইসলামের রীতি অনুযায়ী কোনো দম্পতির মধ্যে তালাক হতে দু’জনেরই সম্মতি থাকতে হবে। একতরফ স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবেন না।
ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে ফোন, হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, ইমেইলে বা ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও তালাক দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। যা একেবারেই অমানবিক।
এক তরফা বা তাৎক্ষণিক তিন তালাককে ইসলাম সমর্থন করে না। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানসহ প্রায় ২২টি মুসলিম দেশে তিন তালাক প্রথা বাতিল করা হয়েছে।
বহু বছর ধরে মুসলিম নারীরা তিন তালাকের বিরুদ্ধে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছেন। কিন্তু শায়েরা বানুর দায়ের করা পিটিশনের রায় দিতে গিয়েই আদালত কেন তিন তালাক স্থগিত করলেন?
তার আইনজীবি বালাজি শ্রীনিভাসন বলেন, মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে আদালত প্রাঙ্গণে নিজের তালাকের ঘটনাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন শায়েরা বানু। প্রথমবারের মতো কোনো মুসলিম নারী এমনটা করেছেন।
শায়েরা বানুর বিয়ে হয়েছিল ২০০০ সালে। ২০১৫ সালে তার স্বামীর পাঠানোর ডিভোর্স লেটারের মাধ্যমে প্রায় ১৫ বছরের বিবাহিত জীবন এক ঝটকায় শেষ হয়ে গিয়েছিল।
স্বামী মারধর করতেন, বাড়ি থেকে বেরও করে দিতেন। কিন্তু ছেলে-মেয়ের কথা ভেবে মুখ বুজে সব সহ্য করেছেন তিনি।
অসুস্থ শায়েরা চিকিৎসার জন্য বাবার বাড়িতে ছিলেন। সে সময় তার স্বামী ডিভোর্স লেটার পাঠান। এতে লেখা ছিল, ‘আমি তোমাকে তালাক দিলাম।’ সেখানে তালাক কথাটি তিনবার লেখা হয়েছিল। এক ছেলে আর এক মেয়ে তখন শায়েরার স্বামীর কাছেই ছিল। তখন থেকে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে দেখাও করতে পারেননি তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি নিজেতো এই তালাক প্রথার শিকার হয়েছি। তাই চাই না যে আগামী প্রজন্মও এর ফল ভোগ করুক। সুপ্রিম কোর্টে আমি সেজন্যই এই প্রথাটাকেই অসাংবিধানিক আখ্যা দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি।’
তার স্বামী আবারও বিয়ে করেছেন। শায়েরা বানুর বলেন, ‘আমার সঙ্গে সে যেটা করেছে, একই ঘটনা যে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গেও করবে না তার কোনও গ্যারান্টি আছে?’
তিনি জানিয়েছেন, এক পাদ্রী তাকে বলেছিলেন যে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই নাকি তিনি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি যদি হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য কোনো ধর্মের হতেন তবে নাকি তিনি মৌলিক অধিকার পেতেন।
এ কথা শোনার পর তিনি আদালতে তার সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পেতে চ্যালেঞ্জ করেন। আর আদালতও তার এই মামলা গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি অবাক হলাম কেন এর আগে এ বিষয়ে কেউ কোনো চিন্তা করেননি। হয়তো এটা চিন্তা করতে পেরেছি বলেই আজকের এই দিনটি দেখতে পেলাম।’
ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন (বিএমএমএ) গত কয়েক বছরে তিন তালাক বাতিলের জন্য বেশ কিছু প্রচারণা চালিয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে তিন তালাক এবং বহু বিবাহের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করেছে সংস্থাটি।
বিএমএমএর প্রতিষ্ঠাতা জাকিয়া সোমান বলেন, আমরা প্রায় সাড়ে চার হাজার নারীকে নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছি। এদের মধ্যে ৫২৫ জন ডিভোর্সি যাদের মধ্যে ৪১৪ জনই তিন তালাকের শিকার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এক তরফা তালাক পাওয়া এসব নারীদের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না।
এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সংস্থাটি তিন তালাক বাতিলের পক্ষে গণস্বাক্ষরের আয়োজন করে। এতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ তিন তালাক বাতিলের পক্ষে স্বাক্ষর করেন।
শায়েরা বানু পিটিশন দায়ের করার দুই মাস পরেই আরো এক নারী তার ডিভোর্সের বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেন। এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আরো তিন নারী এবং বিএমএমএসহ আরো দু’টি নারী সংস্থা সর্বোচ্চ আদালতে একই ধরনের পিটিশন দায়ের করে।
মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, পার্শি ও হিন্দু ধর্মের একজন করে বিচারক মুসলিম নারী সংগঠন এবং তালাক প্রাপ্ত মুসলিম নারীদের দায়ের করা ওই মামলাগুলোর তিন তালাক প্রথা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করেন।
শায়েরা বানো, আফরিন রহমান, গুলশান পারভিন, ইশরাত জাহান ও আতিয়া সাবরি নামের কয়েকজন তালাকপ্রাপ্ত নারী সুপ্রিম কোর্টে যেসব পৃথক মামলা দায়ের করেছিলেন সেগুলোকে একত্রিত করেই সাংবিধানিক বেঞ্চ এই বিশেষ মামলাটি হাতে নিয়েছিল।
অনেকগুলো সংগঠন, সরকারি দপ্তর, জাতীয় নারী কমিশন ও অন্যান্য ব্যক্তিরা এই মামলায় অংশ নিয়েছিল। যদিও মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত একটি প্রথা নিয়ে এই মামলা। কিন্তু এক হিন্দু নারীর দায়ের করা একটি মামলা চলাকালীন সময়েই এর সূত্রপাত হয়েছিল।
কর্ণাটকের বাসিন্দা এক হিন্দু নারী তার পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ পেতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন। সেই মামলার শুনানি চলার সময়েই ওই নারীর বিরোধী পক্ষের আইনজীবী মন্তব্য করেছিলেন যে, আদালতে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন নিয়ে কথা হচ্ছে কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় নিয়মে এমন অনেক কিছু রয়েছে যেগুলোও মুসলমান নারীদের অধিকার হরণ করছে।
ওই মন্তব্যের পরই আদালত তিন তালাক নিয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করার কথা বলে। ভারত সরকার ও আইন কমিশনকে তিন তালাক প্রথা নিয়ে সমস্ত পক্ষের মতামত সংগ্রহ করতে আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
তারপরে ব্যাপকভাবে জনমত সংগ্রহ করে আইন কমিশন। আলোচনা চলে নানা মুসলিম সংগঠনের সঙ্গেও। তিন তালাকের পক্ষে-বিপক্ষে দু’ধরনের মতামতই জমা পড়েছিল।
মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডসহ যারা তিন তালাক প্রথার সমর্থন করেন তাদের দাবি কোনো আদালতই এই প্রথা নিয়ে বিচার করতে পারে না। নিজস্ব ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার যে অধিকার মুসলমানদের রয়েছে তাতে কোনো আদালতই হস্তক্ষেপ করতে পারে না বলে মনে করেন তারা।
মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড কয়েক লাখ মুসলিম নারীর স্বাক্ষর করা পিটিশনও দাখিল করেছিল তাদের বক্তব্যের সমর্থনে।
অন্যদিকে, যেসব সংগঠন তিন তালাকের বিরুদ্ধে তাদের দাবি, শরিয়ত অনুযায়ী যেভাবে তালাক হওয়ার কথা তার যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হয়ে থাকে ভারতে। দু’পক্ষকেই এ বিষয়ে যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছিল তাদের মতামত উপস্থাপনের জন্য।
এরপর মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি তিন তালাক স্থগিতের রায়ের আগে বলেন, তিন তালাক অবৈধ এবং একটি খারাপ কাজ। এটা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে পারে না।
সূত্র : বিবিসি
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন