যে প্রেমের তোলপাড়ে কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ রাজপরিবারও!

মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কলকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের পঞ্চম উত্তরসূরি প্রিন্স হ্যারি। আগামী বসন্তে তাঁদের বিয়ে। তবে মেগান মার্কলের জন্য অভিজ্ঞতাটা নতুন কিছু হবে না। ড্রামা সিরিজ ‘স্যুটস’ দিয়ে খ্যাতি কুড়োনো এ অভিনেত্রী এর আগেও বসেছিলেন বিয়ের পিঁড়িতে।

২০১১ সালে মার্কিন অভিনেতা ও প্রযোজক ট্রেভর অ্যাঙ্গেলসনকে বিয়ে করেছিলেন মেগান। সাত বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর তাঁদের সেই ঘর টিকেছিল মাত্র তিন বছর। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দুজনের। তিন বছর পর প্রিন্স হ্যারির মন কেড়ে নেওয়ায় দুজনের সম্পর্ক এখন বিয়ের পরিণতি পাওয়ার অপেক্ষায়। অথচ মেগান তালাকপ্রাপ্ত হয়েও তাঁর পা পড়বে গোটা বিশ্বে একসময়কার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্রিটিশ রাজপরিবারে। ভাবছেন, এখানে অসুবিধার কী আছে?

না, অসুবিধার কিছু নেই। প্রিন্স হ্যারির বিয়ের ঘোষণাটা তো এসেছে স্বয়ং ব্রিটিশ রাজপরিবারের তরফ থেকেই। মানে, প্রিন্স হ্যারি একজন তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ায় এখন বাকিংহাম প্যালেসের কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের মধ্যগগনের সাক্ষী সেই প্রাসাদেই এমন একসময় এসেছিল, যখন দুবার তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে জীবনসঙ্গী করায় এক রাজাকে সিংহাসন ছাড়তে হয়েছিল!

সেই সময় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সূর্য দিকচক্রবালে। সাম্রাজ্য ছোট হয়ে আসায় তা ক্রমশ গোধূলিমুখী। চারদিকে ভাঙনের আওয়াজ। কিন্তু এর মাঝেই প্রেমের বাঁশি তুলে নিয়েছিলেন এডওয়ার্ড আলবার্ট ক্রিশ্চিয়ান জর্জ অ্যান্ড্রু প্যাট্রিক ডেভিড। সে যেনতেন প্রেম নয়, এমন ঘটনা শুধু সিনেমা-উপন্যাসেই পাওয়া যায়। কিংবা এভাবেও বলা যায়, রাজা পঞ্চম জর্জের জ্যেষ্ঠ ছেলেটি ভালোবাসার মানুষের জন্য সিংহাসন ছেড়ে মাটিতে নেমে আসার উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন বলেই, সেই ঘটনা অনেক রোমান্টিক সিনেমা-উপন্যাসের প্রেরণা।

মেয়েটার নাম ওয়ালিস সিম্পসন। জন্ম মার্কিন পরিবারে। গ্রিম ভাইদের রূপকথার সেই সিনড্রেলার মতো ছিলেন না ওয়ালিস। যদিও রূপকথার সেই সিনড্রেলা এক সাধারণ মেয়ে হয়েও বিয়ে করেছিলেন রাজকুমারকে। কিন্তু ওয়ালিস ব্রিটিশ রাজকুমারকে বিয়ে করেও রানি হতে পারেননি। পাননি কোনো সম্মানসূচক উপাধি। কারণ, মেয়েটা দুবার তালাকপ্রাপ্ত। সেই সময়ে তালাকপ্রাপ্ত মানুষের আদালতে যাওয়ারই অধিকার ছিল না, আর রাজকুমারকে বিয়ে করে ব্রিটিশ রাজপরিবারে প্রবেশ করাটা তো বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার শামিল!

এডওয়ার্ড ছিলেন সুদর্শন পুরুষ। সোনালি চুল, নীল চোখ আর সুবোধ বালকসুলভ ব্যক্তিত্বের জন্য মেয়েদের কামনা-বাসনার ধন। অন্যদিকে ওয়ালিস খুব সুন্দরী না হলেও চেহারায় দীপ্তি ছিল, ছিল আকর্ষণীয় শারীরিক গঠন আর ফ্যাশন সচেতন। ১৯৩১ সালের ১০ জানুয়ারি এক পার্টিতে ওয়ালিসের সঙ্গে এডওয়ার্ডকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর তৎকালীন প্রেমিকা লেডি ফারনেস। ওয়ালিস তত দিনে দ্বিতীয় স্বামীর ঘর করছেন।

কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই তাঁর প্রেমে ডুবে যান এডওয়ার্ড। ওয়ালিসকে দামি উপহার আর বিদেশে ছুটি কাটাতে গিয়ে রাজকার্যে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন রাজকুমার। কিন্তু এড়ানোর পথ ছিল না। ১৯৩৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর রাজা হন এডওয়ার্ড। পরের দিনই প্রথা ভেঙে সেন্ট জেমস প্যালেসের জানালায় দেখা দেন নতুন রাজা, পাশে ছিলেন ওয়ালিস সিম্পসন—তিনি তখনো আর্নস্ট সিম্পসনের স্ত্রী!

গুজব চাউর হয়েছিল বেশ আগে থেকেই। তবে রাজপরিবারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলো সেদিন এ নিয়ে কোনো খবর প্রকাশ করেনি। কিন্তু বিদেশি পত্রপত্রিকাগুলো ছাড় দেবে কেন? তাঁরা ফলাও করে ছাপল। এদিকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের ভূলুণ্ঠিত হওয়ার অবস্থা। আদালত আর সরকারকে নড়েচড়ে বসতেই হলো। সেই ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে এডয়ার্ডের জন্য সুখবর বয়ে আনলেন ওয়ালিস। তাঁর দ্বিতীয় ঘরটাও ভেঙেছে। কিন্তু রাজাকে কি বিয়ে করা যাবে?

দুইবার তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে এডওয়ার্ড বিয়ে করলে সরকার পদত্যাগ করবে, এমন হুমকি দেওয়া হলো। একজন দুবার তালাকপ্রাপ্ত সাধারণ এক মার্কিন পরিবারের মেয়েকে ব্রিটিশ রাজার বিয়ে করার সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বয়ং ইংল্যান্ডের চার্চ, যেখানে রাজা নিজেই চার্চের প্রধান! তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলে বল্ডউইনও এডওয়ার্ডের এই অন্ধ প্রেমের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেন। বল্ডউইন এডয়ার্ডকে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন—১. ওয়ালিসকে বিয়ের চিন্তা বাদ দাও। ২. প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করা। ৩. সিংহাসন ত্যাগ করা।

চাপ সহ্য করতে না পেরে ওয়ালিস তখন পালিয়ে ফ্রান্সে। সিদ্ধান্ত নিলেন এডওয়ার্ডের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবেন না। কিন্তু এডওয়ার্ড জানতেন, সেটা তাঁর মনের কথা নয়। প্রেয়সীর মনের কথাটা বাস্তবে প্রতিফলিত করতেই বল্ডউইনকে এডওয়ার্ড জানিয়ে দেন, তিনি তৃতীয় প্রস্তাবটিতে রাজি! ১৯৩৬ সালের ১০ ডিসেম্বর এডওয়ার্ড ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘অ্যাবডিকেশন’ (পদত্যাগ) জমা দেন। পরদিন তা অনুমোদন করা হয়।

মাত্র ৩২৬ দিনের মাথায় সিংহাসন ত্যাগ করে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম মেয়াদি রাজার তালিকায় নাম লিখিয়েছিলেন অষ্টম এডওয়ার্ড। এরপর তিনি চলে যান ফ্রান্সে, তাঁর প্রেয়সীর কাছে। ১৯৩৭ সালের ৩ জুন এডওয়ার্ড ওয়ালি সিম্পসনকে বিয়ে করে প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। তাঁরা কি সুখী হতে পেরেছিলেন? বেঁচে থাকতে ওয়ালিস শুধু একবার বলেছিলেন, কেউ জানে না অমর এক প্রেমকাহিনির মতো জীবন যাপন করা কত কঠিন!