‘রক্তমাখা কাপড়ে ছেলেকে কবরে রেখে এসেছি’
সীমান্ত অতিক্রম করে আসা রোহিঙ্গা মা সানজিদা খাতুন এখন পাথর, কারণ সেনাবাহিনীর গুলি ও মাইনের আঘাতে চোখের সামনে প্রাণ গেছে কিশোর ছেলের।
কবর দেওয়ার সময় একটু কাপড়ও দিতে পারেননি। দশ সন্তানের আরেক জনের কোন খোঁজ নেই কয়েকদিন ধরে। তিনদিন আগে সীমান্ত অতিক্রম করা রাখাইন প্রদেশের বুচিডং এর টংবাজারের সানজিদা খাতুন ও তার স্বামী জাকারিয়ার সাথে শুক্রবার রাতে কথা হয় টেকনাফের কানজর পাড়ায়। এখানকার একটি বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন পুরো পরিবার নিয়ে এই দম্পতি।
মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, ২৫ আগষ্ট শুক্রবার দুপুরের দিকে গ্রামে হামলা হয়, গুলি ও বিস্ফোরনে ছেলে সাইফুলের হাটু থেকে নীচের অংশ ঝড়ে গেছে। গুলির মধ্যে ছেলেকে কাঁধে করে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গিয়েছিলাম, বাচাতে পারেনি। ‘রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো আমার ছেলে, মায়ের কাছে যেতে চাইছিলো, মায়ের কোলে সে মারা যায়, তখন পাড়ার সব লোক অন্য দিকে সরে ছিলো, তিন চারজন মিলে দাফন করেছি, ছেলের গায়ে রক্তমাখা যে কাপড় ছিলো তাই দিয়ে কবরে শুয়ে দিয়েছি, উল্লেখ করেন তিনি।
মা সানজিদা খাতুন বলেন, ‘ছেলেকে যখন আমার কাছে এনেছে তখন পুরো শরীরে রক্ত, একটু পানি খেতে চেয়েছে, বুকে জড়িয়ে ধরতে বলেছে, বলেছে আমাকে মাফ করে দিও। ছেলেকে দাফন করার সময় কাফনের কাপড় দূরে থাকুক এক টুকরো কাপড়ও দিতে পারিনি, পরনে যা ছিলো তা দিয়েই কবরে রেখে আসতে হয়েছে, অতিকষ্টে বলেন নির্বাক সানজিদা খাতুন।
১৫ বছরের ছেলে সাইফুল ছাড়াও জাকারিয়া-সানজিদা দম্পতির আরো কয়েকজন নিকট আত্মীয় সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছে। ছেলে মারা যাওয়ার বিভৎস ঘটনাও এখন আর তেমন প্রতিক্রিয়া নেই তাদের, কারণ যে সন্তানরা জীবিত আছে তাদের মধ্যে একজন নিঁখোঁজ। অপর আটজনকে নিয়ে এখন কোথায় যাবেন।
বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরনার্থীর সংখ্যা তিন লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে যা পুর্বের সব সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।। টানা ১৫দিন ধরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। যে দুর্ভোগ সহ্য করে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা সীমান্ত অতিক্রম করছে তা এক কথায় অবর্ণনীয়।
৩০বছরের বিধবা রহিমা, তিন কিশোর সন্তান নিয়ে মংডুর দারোগা পাড়ার স্বামীর ভিটে ছেড়ে এসেছেন তিনদিন আগে। শরীরিক যন্ত্রনার পাশাপাশি ঘর বাড়ী সহায় সম্বল কেড়ে নেওয়ার যন্ত্রনায় বিলাপ এখন তার একমাত্র অবলম্বন। কানজর পাড়ার বিলের আইলে বসে থাকা অবস্থায় মিয়ানমারের পরিস্থিতি কেমন এটা জানতে চাওয়া হলে রহিমা শুধুই বিলাপ করেছেন। মিয়ানমারের সাথে ২৭১কিলোমিটার সীমান্ত জুড়েই এমন পরিস্থিতি। এখানে কেউ কাউকে সান্তনা দেওয়ার পর্যায়ে নেই।
ষাটোর্ধ হাসিনা খাতুন নিজের দেশে কয়েকবার সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের অত্যাচার দেখেছেন কিন্তু কখনো দেশ ছাড়ার চিন্তা করেননি, এবার ঠিকই ছেলে ও নাতির কাঁধে চড়ে শরনার্থীর জীবন গ্রহণ করতে হলো। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী গত ২৫ আগষ্ট থেকে রাখাইনে সেনা ও পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে এক হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। বাস্তুচ্যূত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে দুই লাখ সত্তর হাজার রোহিঙ্গা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৮, ১৯৯২ ২০১২ ও ২০১৬ চার চার বার বড় ধরনের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে।
এবারের শরনার্থীরা বলছেন তাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন অতীতের সব নির্যাতনকে হার মানিয়েছে। সে কারণে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি সংখ্যক শরনার্থী অনুপ্রবেশ করেছে। অতিক্রমের সময় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা দুর্ভোগ পেরিয়ে এই সংখ্যা কত গিয়ে ঠেকবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
রোহিঙ্গারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। এদের বেশির ভাগই মুসলমান। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হলো রোহিঙ্গা। সংখ্যায় প্রায় ২০ লাখ। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও উগ্র রাখাইনদের সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হয়ে প্রায় ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বেসামরিক সশস্ত্র গোষ্ঠী ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের ধারাবাহিক নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়ে বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। মূলত ১৯৭০ দশক থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছাড়তে শুরু করে। গত সাড়ে চার দশকে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। পৃথিবীর কোন দেশে কত রোহিঙ্গা আছে তার একটি ‘আপাত’ হিসাব দিয়েছে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরা। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার বরাতে পাওয়া এ তথ্য আজ শনিবার এক প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়েছে।
রাখাইনের বাইরে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা আছে বাংলাদেশেই। এদের বেশিরভাগই কক্সবাজারের উপকূলবর্তী বিভিন্ন নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পে এরা অবস্থান করছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাব অনুযায়ী, সহিংসতার শিকার হয়ে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) গতকাল শুক্রবার সর্বশেষ জানিয়েছে, নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর দুই লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই সংখ্যা বেড়ে তিন লাখের উপরে যাবে। অর্থাৎ গত ১১ মাসে সাড়ে তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এরই মধ্যে বাংলাদেশে এসেছে। এই সময়ে মিয়ানমারে সহিংসতায় মারা গেছেন প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সূত্র মতে, কক্সবাজার উপজেলার বিভিন্ন উপকূলে যেসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে, সেখানে দশকের পর দশক ধরে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এদের মধ্যে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত উভয় শরণার্থীই রয়েছেন। অনেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।
এদিকে আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ছয় লাখ ২৫ হাজার। যদিও এর চেয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে বলে ধারণা করেন স্থানীয়রা।
অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে মিয়ানমারের রাখাইন ছেড়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়াতে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ১ লাখ ১২ হাজার রোহিঙ্গা। ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৩ বছরে তারা মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন।
গত আগস্টে নতুন করে সহিংসতা শুরুর আগে জাতিসংঘ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছেন। এ সময় আরও ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ার কথাও বলা হয়।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবে রয়েছে ২ লাখ, পাকিস্তানে সাড়ে ৩ লাখ, মালয়েশিয়ায় দেড় লাখ, ভারতে ৪০ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১০ হাজার, থাইল্যান্ডে ৫ হাজার এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।
এদিকে নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর গত দুই সপ্তাহে প্রায় ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশে। তবে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, এর সংখ্যা ২ লাখ ৭০ হাজার।
মিয়ানমারের উপকূলবর্তী রাজ্য রাখাইন। সেখান থেকে নৌকায় করে বঙ্গোপসাগর, আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়ার উপকূলে পৌঁছায়। এভাবে ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিন বছরে প্রায় এক লাখ ১২ হাজার রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। তাঁরা সেখানে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে শেল্টার সেন্টারে আশ্রয়ে আছে। গতকাল শুক্রবার মালয়েশিয়ার মেরিটাইম এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির মহাপরিচালক জুলকিফলি আবু বাকার বলেছেন, তাদের উপকূলে যাওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের তাঁরা ফেরাবে না, আশ্রয় দেবে।
গত আগস্টে নতুন করে সহিংসতা শুরুর আগে জাতিসংঘ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রায় চার লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। এ সময় আরো এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ার কথাও বলা হয়।
গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের’ সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এই হামলার দায় স্বীকার করে। এ ঘটনার পর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে।
মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে জাতিসংঘ গত ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৭০ জন ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’, ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দুজন সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৪ জন সাধারণ নাগরিক।
মিয়ানমার সরকারের আরো দাবি, ‘বিদ্রোহী সন্ত্রাসীরা’ এখন পর্যন্ত রাখাইনের প্রায় দুই হাজার ৬০০ বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এখনো রাখাইন রাজ্যে থাকা মুসলিমদের মধ্যে মাইকে প্রচার চালাচ্ছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
প্রসঙ্গত, সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তী সময়ে চাটগাঁইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মিশ্রণে এই জাতি ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
রোহিঙ্গাদের বসবাসস্থল রাখাইন রাজ্য। এর আদি নাম আরাকান। এ নামকরণ প্রমাণ করে মুসলিম ঐতিহ্যের কথা।
কারণ ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তিকে একত্রে বলা হয় আরকান। আর এই আরকান থেকেই তার অনুসারী মুসলমানদের আবাস ভূমির নামকরণ করা হয়েছে আরাকান।
ধারণা করা হয়, রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে : ম্রোহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানের উল্লেখ রয়েছে রোসাং নামে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন