রুদ্রতার আভাস দিয়ে নিম্নচাপটি এখন লঘুচাপে
সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সাত দফা দাবি আদায়ের জন্য সরকারপ্রধানের সঙ্গে দুই দফায় বৈঠক করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সংগত কারণে প্রশ্ন এসে যায়, এই সংলাপ থেকে বিরোধী পক্ষ কী অর্জন করল, আর সরকারপক্ষই–বা কী ছাড় দিল।
আপাতদৃষ্টিতে যা দেখা যাচ্ছে, এতে সরকারপক্ষ বিরোধী পক্ষের মোটাদাগের দাবিগুলোর একটিও মেনে নেয়নি; যদিও সরকারপক্ষের মুখপাত্র ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বেশির ভাগ দাবিই মেনে নেওয়া হয়েছে।
ঐক্যফ্রন্টের দাবি সাতটি হলেও মূল দাবি হলো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, সরকার ও বিরোধী পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের মাঠে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন ও নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করা।
যে দাবিগুলো মেনে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো হলো ব্যক্তি, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশের অভিযোগে করা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তার হওয়াদের মুক্তি দেওয়া, নির্বাচনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা।
এখন প্রশ্ন হলো—নির্বিষ এই দাবিগুলো মেনে নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়টি নির্বাচনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের মাঠে সরকার এই বেশির ভাগ দাবি মেনে নিয়ে যদি শতভাগ প্রয়োগও করে থাকে, সেটাকে ঐক্যফ্রন্টের বিশেষ কোনো অর্জন হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। কারণ, এই ছাড় নির্বাচনের মাঠে সরকারপক্ষকে বড় ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করানোর শক্তি রাখে না।
এবার আসা যাক মোটাদাগের দাবিগুলোর প্রসঙ্গে, যেগুলো সরকার মেনে নেয়নি। মেনে না নেওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, এই দাবিগুলো মেনে নিলে যে আওয়ামী লীগের তখ্ত ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে। আর এমনই যদি ঘটে, সেই পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকারের আকার, আয়তন বা প্রকৃতি কেমন হবে, সেটি সহজে অনুমান করা যায়। সেটি হবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলের কিছু একটা। সহজ এই সমীকরণ ক্ষমতাসীন দলের কাছে যেমন পরিষ্কার, তেমন পরিষ্কার ঐক্যফ্রন্টের কাছেও।
অবশ্য সরকার সব দাবিই মেনে নেবে বা মেনে নিতে বাধ্য হবে, যদি বিরোধী পক্ষ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর প্রচণ্ড মাত্রার চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যেমনটা আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে সফলভাবে প্রয়োগ করে বিএনপিকে ক্ষমতাছাড়া করেছিল। কিন্তু বিএনপিকেন্দ্রিক ঐক্যফ্রন্ট সেই রকম চাপ প্রয়োগ করার মতো কোনো আন্দোলন এখনো গড়ে তুলতে পারেনি। বিষয়টিকে আরও সহজ করে বলা যায়—রিখটার স্কেলের তিন মাত্রার ভূকম্পন এতটাই মৃদু যে সেই কম্পন মাঝেমধ্যে সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাও টের পান না। অন্যদিকে, আট-নয় মাত্রার একটি ভূকম্পনের প্রচণ্ডতা সৃষ্টি করতে পারে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের। অথচ দুটোই ভূকম্পন!
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আন্দোলনের অবস্থা এখন অনেকটাই তিন মাত্রার ভূকম্পনের মতো। তাদের সরকারবদলের আন্দোলন এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের শিবিরে বড় ধরনের কোনো কম্পন সৃষ্টি করতে পারেনি। নেই কোনো আফটার শকও। উল্টো সরকারপক্ষের সঙ্গে দুই দফায় সংলাপের পর সাত দফার অবস্থা এখন অনেকটাই ‘দফারফা’ হয়ে গেছে।
দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুই দফায় সংলাপের পর ঐক্যফ্রন্টের অর্জন কী? বিষয়টি ঐক্যফ্রন্টের নেতারা যতটা না পরিষ্কার করে বলতে পেরেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার হয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বয়ানে। বুধবারের সংলাপ শেষে তাঁর বক্তব্যের সারাংশ হলো—বিদ্যমান সংবিধান অনুসরণ করেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ সরকার থাকবে, সংসদ থাকবে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন হবে না, কমিশন যে তফসিল ঘোষণা করবে, সেই দিনক্ষণ মেনে নির্বাচন হবে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের উত্তর ছিল যথেষ্ট কৌশলী। তিনি বলেছেন, প্রকৃত যাঁরা রাজবন্দী, তাঁদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। তবে খালেদা জিয়ার মামলা তো এই সরকার করেনি, করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সুতরাং খালেদা জিয়ার জামিন বা মুক্তির বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে।
ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম একটি দাবি, সশস্ত্র বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য অনুযায়ী, এটিও গ্রহণযোগ্য নয়।
অবশ্য সশস্ত্র বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের মাঠে মোতায়েন–সম্পর্কিত বিএনপির এই দাবি গণতান্ত্রিক কাঠামোয় একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, বিচারের মূলমন্ত্র হলো বাদী অভিযোগ করবেন। তৃতীয় পক্ষ, অর্থাৎ বিচারক বিচার করবেন। বাদীকে বিবাদীর বিচারের ক্ষমতা দেওয়াটা বিচারহীনতার শামিল। এর সঙ্গে বিচার বিভাগের মর্যাদার বিষয়টিও সম্পর্কিত।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঐক্যফ্রন্টের এই দাবি বিভ্রান্তিকর। নির্বাচনের মাঠে সশস্ত্র বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হলে তারা অপরাধীদের গ্রেপ্তার করবে এবং তারাই বিচার করবে। এটা কখনোই সুবিচারের মানদণ্ড হতে পারে না। বরং ঐক্যফ্রন্ট যদি সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনী অপরাধে সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়ার দাবি করত, সেটা হতো অনেক বেশি যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য।
সুতরাং বলা যায়, ঐক্যফ্রন্ট সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের দাবিটিও যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সুবাদে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা তাদের ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীর নাম ছেঁটে ফেলে। ঐক্যফ্রন্ট এই আইন পুনর্বহালের দাবি জানালে সেটা নিয়ে বরং সরকারপক্ষের সঙ্গে ভালো দর-কষাকষি করতে পারত।
সর্বশেষ ঐক্যফ্রন্ট নিজেদের মাঠের কর্মসূচি সংকুচিত করেছে। ঘোষণা ছিল, ঢাকা থেকে রোডমার্চ করে গিয়ে বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে সমাবেশ করবে। কিন্তু বুধবার সরকারপক্ষের সঙ্গে সংলাপের পর আকস্মিক জানানো হলো, রোডমার্চ হবে না, শুধু সমাবেশ হবে। গণমাধ্যম বিভিন্ন সূত্র থেকে বলছে, ফ্রন্টের নেতা-কর্মীরা পথে পথে গ্রেপ্তার হতে পারেন, সেই আতঙ্কে রোডমার্চ বাতিল করা হয়েছে। গণমাধ্যমের দেওয়া এই তথ্য যদি সত্য হয়, তবে আবহাওয়াবিদের ভাষায় বলতে হবে, রুদ্রমূর্তির আভাস দেওয়া নিম্নচাপটি দুর্বল হয়ে লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। সৌজন্যে : প্রথম আলো।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন