রোহিঙ্গাদের ‘বিদ্রোহী গ্রুপ’ আরাকান আর্মি কারা?

মিয়ানমারে যে সশস্ত্র হামলার পর রাখাইন প্রদেশ আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে তার জন্য মিয়ানমারের সরকার দোষারোপ করছে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ নামে একটি সংগঠনকে।

এর আগে গত বছরের অক্টোবরেও রাখাইনে পুলিশ ফাঁড়ির ওপর হামলার ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছিল এই গোষ্ঠীটিকে।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে এরকম সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা আগেও শোনা গেছে, কিন্তু এই সংগঠনটির নাম এর আগে কেউ শোনেননি।

এ সংগঠনের পেছনে কারা- তার একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে বিবিসি বাংলা। তারা লিখেছে,

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি আগে ইংরেজীতে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে তাদের তৎপরতা চালাতো। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে।

মিয়ানমারের সরকার ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করেছে।

মিয়ানমার বলছে, এই গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে রোহিঙ্গা জিহাদীরা, যারা বিদেশে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তবে সংগঠনটি কত বড়, এদের নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত, তার কোনো পরিস্কার ধারণা তাদের কাছেও নেই।

মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের ধারণা, এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছে ‘আতাউল্লাহ’ নামে একজন রোহিঙ্গা। তার জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে, বেড়ে উঠেছে সৌদি আরবে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ তাদের এক রিপোর্টে বলছে, সংগঠনটি মূলত গড়ে উঠেছে সৌদি আরবে চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দ্বারা।

মক্কায় থাকে এমন বিশজন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা এই সংগঠনটি গড়ে তোলে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতে এদের যোগাযোগ রয়েছে।

সংগঠনটির নেতা আতাউল্লাহ ‘আবু আমর জুনুনি’ নামেও পরিচিত। আতাউল্লাহর বাবা রাখাইন থেকে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। সেখানেই আতাউল্লাহর জন্ম। তিনি বেড়ে উঠেছেন মক্কায়। সেখানে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। ইউটিউবে তার একটি ভিডিও থেকে ধারণা করা হয়, রাখাইনের রোহিঙ্গারা যে ভাষায় কথা বলে সেটি এবং আরবী, এই দুটি ভাষাই তিনি অনর্গল বলতে পারেন। ২০১২ সালে আতাউল্লাহ সৌদি আরব থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। এরপর সম্প্রতি আরাকানে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর তার নাম শোনা যায়।

আরাকানে যারা এই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত, তাদের আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ আছে বলে মনে করা হয়। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই সংগঠনটির প্রতি সমর্থন এবং সহানুভূতি আছে।

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা ‘আরসা’ গত মার্চে এক বিবৃতিতে একেবারে খোলাখুলিই জানিয়েছে, তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে এবং তাদের ‘আত্মরক্ষা-মূলক’ হামলার মূল টার্গেট হচ্ছে মিয়ানমারের ‘নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী’।

আরসার প্রধান দাবি হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব এবং সমান মর্যাদা দিতে হবে।

‘আরসা’ তাদের এই বিবৃতিতে আরও বলেছে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত নয়। তাদের অধিকার আদায়ের জন্যও তারা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী নয়। বিশ্বের কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই।

এমনকি তারা রাখাইনের বিভিন্ন ধর্মের ও জাতির মানুষকে এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনার স্থানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিচ্ছে।

লন্ডনভিত্তিক একটি রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান ন্যাশনাল রোহিঙ্গা অর্গেনাইজেশনের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, গত অক্টোবরে প্রথম রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির কথা সবাই জানতে পারে। তারা তখন একটি পুলিশ ফাঁড়ির ওপর হামলা চালিয়েছিল।

তার মতে, যারা এই সংগঠনে যুক্ত হয়েছে, তারা মরিয়া হয়ে এরকম একটা পথ বেছে নিয়েছে।

‘মাঝে মধ্যে ইন্টারনেটে এদের বক্তব্য-বিবৃতি দেখি। এরা আরাকানে রোহিঙ্গাদের অধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য লড়ছে।’

‘এরা উগ্রবাদীও নয়, কোনো আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গেও এদের সম্পর্ক নেই। এরা আরাকানে বেড়ে উঠা একটি গোষ্ঠী যারা রোহিঙ্গাদের জন্য লড়ছে বলে দাবি করে।’

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংগঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান পুরো আরাকানের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সরকার যদি রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে নির্বিচার সামরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে এদের দমন করতে যায়, তাতে বরং সেখানে চক্রাকারে সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়বে।

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মুখপাত্রের সাক্ষাৎকার

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) বলেছে, তাদের সশস্ত্র বিদ্রোহ জেহাদ নয় বরং তারা জাতিগত মুক্তিকামী। মিয়ানমারের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করাই তাদের উদ্দেশ্য। ২৫ আগস্টের হামলা ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরে পাওয়া পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে বলে তারা ঘোষণা করেছে।

২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিক্রিয়া থেকেই আরসার জন্ম বলে বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানান সংগঠনের প্রধান নেতার মুখপাত্র ‘আবদুল্লাহ’। তিনি বলেন, আরসা ধর্মভিত্তিক নয়, জাতিগত অধিকারভিত্তিক সংগঠন।

হংকংভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত এ সাক্ষাৎকারে আবদুল্লাহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বলেন, মুসলমান বলেই আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সঙ্গে আন্তর্জাতিক জিহাদি তৎপরতার সম্পর্ক আছে বা তারা আমাদের খেয়ে ফেলতে পারবে, এমন দাবি ঠিক নয়।

‘মিয়ানমারের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের অবস্থান পুনর্বহাল করতে হবে’, বলেন আবদুল্লাহ। ‘যত দিন আমাদের দাবি মানা না হবে, তত দিন প্রতিরোধ চলবে। যদি এ দাবি না মানা হয়, তাহলে সংগ্রাম ‘অন্য স্তরে’ নেওয়া হবে। নিজেকে তিনি আরসার প্রধান নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির নিয়োজিত মুখপাত্র বলে দাবি করেন।

এশিয়া টাইমসের মাইক উইনচেস্টারের নেওয়া ওই সাক্ষাৎকারের ভূমিকায় বলা হয়, নিরাপত্তার কারণে আবদুল্লাহর অবস্থান প্রকাশ করা হয়নি। ২৫ আগস্টের হামলার এক দিন পরে এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

এশিয়া টাইমস নিশ্চিত করে বলেছে, আবদুল্লাহর সঙ্গে আরসার সামরিক কমান্ডারের প্রতিদিনই কথা হয়। আবদুল্লাহকে শহুরে শিক্ষিত বলে মনে হয়েছে এশিয়া টাইমসের সাংবাদিক মাইক উইনচেস্টারের কাছে।

অন্য স্তরে বলতে ‘স্বাধীনতা’ কি না, তা স্পষ্ট করেননি আবদুল্লাহ। বরং তিনি বারবারই জোর দিয়ে বলেন, ‘আরসার লড়াই জাতীয়তাবাদী। ‘আমরা জিহাদি নই। আরসার কর্মপদ্ধতি, কাজের ধরন, যেভাবে তারা সংগঠন চালায় এবং যে লক্ষ্যের দিকে তারা চলছে, তাতেও এটা স্পষ্ট। এর কোনোটাই পাকিস্তানি কিংবা অন্য কোনো জিহাদি গোষ্ঠীর লক্ষ্যের সঙ্গে মেলে না। আমরা আসলে মিয়ানমারের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোরই মতো।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তার আহ্বান, আরসাকে ‘সন্ত্রাসবাদী ভাবা’ কিংবা ‘মিয়ানমার সরকারের ফাঁদে পড়া’ থেকে সতর্ক থাকুন।

মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে আরসাকে ‘বাঙালি সন্ত্রাসবাদী’ বলে অভিযোগ করে আসছে। ২৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনটিকে বেআইনি ঘোষণা করে মিয়ানমার। আবদুল্লাহ রাখাইনে বেআইনি বাংলাদেশি অভিবাসনের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এটা বলে তারা আমাদের ন্যায্য দাবিকে দমিয়ে রাখতে চাইছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জীবন অনেকটা লৌহযুগে পড়ে আছে, অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই। সেখানে নিয়মিতভাবে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন-হত্যা করা হয়। প্রাণহানির ঝুঁকি নিয়ে কেন বাংলাদেশিরা সেখানে অভিবাসন করবে?’

কার্যত আশির দশকের গোড়া থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছে।

আবদুল্লাহ জানান, ২০১৩ সাল থেকে আরসা রাখাইনে কাজ করা শুরু করে। মূলত ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরে রোহিঙ্গা যুবকদের মধ্যে যে রাগ ও জেদ তৈরি হয়েছিল, তা থেকেই এর জন্ম। ওই দাঙ্গায় শত শত রোহিঙ্গা নিহত হয় এবং ৮৫ হাজার বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তা ছাড়া রাখাইন প্রদেশের রাজধানীর কাছে অবরুদ্ধ বস্তিগুলোতে আটকে আছে আরও ১ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা।

‘আরসা ২০১২ সালের ঘটনার সরাসরি প্রতিক্রিয়া। সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগ আছে এবং দুনিয়া বিষয়ে অভিজ্ঞ নতুন এক রোহিঙ্গা প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন আরসা।’ আবদুল্লাহ বলে চলেন।

মধ্যবয়সী ব্যক্তিটির ইংরেজি বলার ধরন অভিজাত। দুজন যুবক ছিলেন তার সঙ্গী। তিনি জানান, প্রবাসী রোহিঙ্গাদের থেকেই তাদের নেতা আতাউল্লাহ জুনুনি এসেছেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাকিস্তানের এক রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবারে। পরে তিনি সৌদি আরবে চলে যান। সেখানকার দেড় লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি মসজিদের ইমাম ছিলেন। সদ্য চল্লিশ পেরোনো এই আরসা নেতা ২০১৩ সালে রাখাইনে ফিরে যুবকদের সংগঠিত করা শুরু করেন।

বাইরে থেকে আসা অস্ত্রের চালানের কথা আবদুল্লাহ অস্বীকার করলেও আগে প্রচারিত একটা ভিডিওতে দেখা যায়, রোহিঙ্গা যুবকেরা নতুন কালাশনিকভ রাইফেল হাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। গত ১৫ আগস্ট জুনুনি এক ইউটিউব ভিডিও বার্তায় প্রথম হাজির হন।

যখন কফি আনান মিয়ানমার সফর করছেন, ঠিক সে সময় কেন আরসার যোদ্ধারা ২৫ থেকে ৩০টি পুলিশি অবস্থানে হামলা চালাল? এ প্রশ্নের উত্তরে আবদুল্লাহ বলেন, আত্মরক্ষার জায়গা থেকে আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।

তিনি দাবি করেন, মংডু এবং রাথেডুং এলাকার গ্রামগুলোতে আগেই সরকারি সেনা অভিযান চলছিল। কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে বয়স্ক ব্যক্তিদের বেঁধে ফেলা হয় এবং ২৫ জনের বেশি গুলিতে নিহত হয়। পাশাপাশি জায়ে দি পায়েইন গ্রাম পুরো ঘিরে ফেলা হয়। এসব আঘাতের জবাব দিতেই আরসা এ সময় হামলার সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানান আবদুল্লাহ।

আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলে সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মাইক উইনচেস্টারের মনে হয়েছে, হয় আরসা কফি আনানের প্রতিবেদনে কী আছে তা জানত না, নতুবা এ সফরকালে রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে বিশ্বের মনোযোগের সুযোগ নিয়ে আরসা নাটকীয়ভাবে শক্তি দেখাতে চেয়েছে। তবে আরসা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধানই চায় বলে জানান আবদুল্লাহ। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই তা সম্ভব।

‘স্বল্প মেয়াদে আমাদের বাহিনী পৃথিবীর কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে যে আমরা যে অনাচারের শিকার হয়েছি তা অনেক গভীর। আমরা বিচার চাই এবং বিশ্বাস করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের প্রতি রাজনৈতিক চাপ বাড়াবে। পূর্ণমাত্রার গণহত্যার আগের চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা আছি। তাই আমাদের বেসামরিক জনগণকে আমাদের বাঁচাতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের সামরিক ও রাজনৈতিক শাখা সংলাপের লক্ষ্যে একযোগে কাজ চালিয়ে যাবে। আমরা দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা সংগ্রামের চিন্তা করছি না। আমরা আশা হারাব না। আরাকানের সন্তান রাখাইনদের প্রতি আমাদের বার্তা হলো, আমরা একসঙ্গে বাস করতে পারি। আরাকান রোহিঙ্গা ও রাখাইন উভয়েরই। আরাকানের গৌরব মারাক উ রাখাইন ও মুসলিমরা একযোগেই তো তৈরি করেছিল।’

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তার কাছে সঠিক নির্ভরযোগ্য তথ্য যায় না। তিনি সেনাবাহিনী এবং তার দলের রাখাইন সদস্যদের ফাঁদে পড়ে আছেন। তারা তাকে বিকৃত তথ্য দিচ্ছে। নিজে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসার নৈতিক দায়িত্ব তো তার থাকা উচিত।’

সু চি অবশ্য আরসাকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে অভিহিত করে মিয়ানমারের গণমাধ্যমকে তাদের পক্ষে কথা বলার ব্যাপারে সাবধান করে দেন।

তাদের কি কোনো বিকল্প ছিল?

ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক এবং “Forging Peace in Southeast Asia: Insurgencies, Peace Processes, and Reconciliation.” গ্রন্থের লেখক যাকারি আবুজা তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন,

মিয়ানমার যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের পথে, ঠিক সে সময় অর্থাৎ ২০১২ সালে মিয়ানমারে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা ও মুসলিম বিরোধী সহিংসতার ঘটনা ঘটে। যদিও সেবারকার মাত্রা অত তীব্র ছিল না। বলতে গেলে, সেই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ হওয়ার সুযোগই করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আং সান সুচির নতুন গণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করছিল।

বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমারে পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে আসছিল। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি বা আইনগত সুরক্ষা নেই, সরকার তাদের কাজ পাওয়ার অধিকার, খাদ্যের অধিকার বা চিকিৎসার অধিকার সংকুচিত করে রেখেছে। এই প্রেক্ষাপটে সেখানে পুরো মাত্রায় বিদ্রোহ দেখা দেবে সেটাই স্বাভাবিক।

২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিদ্রোহ ছিল একবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। হারাকাহ আল ইয়াকিনের প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মা জুনুনি মিয়ানমারে ফিরলে বিদ্রোহ শুরু হয়।

বিদ্রোহী এই গোষ্ঠীটি জনসমক্ষে নিজেদের আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশ আর্মি নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। ২০১৬ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ছোট ছোট হামলাও চালাতে শুরু করে তারা। অন্যদিকে রাখাইনে বেশিরভাগ সহিংসতা ঘটায় সরকারি সমর্থনপুষ্ট স্থানীয় কিছু লোকজন। এদের দায়িত্ব ছিল নজরদারি করা, যাদেরকে কখনই মিয়ানমার সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেনি।

সরকার পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালায়, সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করে ও রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেয়। জাতিসংঘের হিসেবে গত বছর অক্টোবর-নভেম্বরে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় ঢুকে পড়ে। আগে থেকেই এ অঞ্চলে ছিল আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা।

গত মাসের শেষের দিকে, জাতিসংঘের বিশেষ দূত কফি আনান এক কোটি দশ লাখ রোহিঙ্গার ওপর মিয়ামনার সরকারের অন্যায় আচরণের অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিবেদন পেশ করার দুই দিনের মাথায় রাখাইনে ২৪ থেকে ৩০টি নিরপত্তা চৌকিতে দেড়শ আরসা হামলা চালায়। হামলার দায় স্বীকার করে আরসা দাবি করে, তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য ওই হামলা চালিয়েছে।

অপরিকল্পিতভাবে চালানো ওই হামলা বিফলে যায়। ওতে আরসার ৭৭ জন নিহত হবার বিপরীতে নিহত হন মাত্র এক ডজন পুলিশ। ওই হামলা সফল হওয়ার জন্য পরিচালিত হয়নি, বরং কৌশলগত বিজয়ই ছিল এ হামলার লক্ষ্য।

আরসা খুব ভালোভাবেই জানত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কীভাবে ওই হামলার জবাব দেবে। তারা চূড়ান্ত শক্তিপ্রয়োগ করে এবং মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে একটি ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালাবে এটাই অনুমেয় ছিল। ফলে ২৮ আগস্টের মধ্যে মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১০৪ এ।

কয়েক দিনের মাথায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সীমান্তের কাছে নো ম্যানস ল্যান্ডে আটকা পড়ে আরও অনেক মানুষ। এর আগে নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর গুলি চালায় সামরিক বাহিনী। ওই মানুষগুলো সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করেছিল। তাদের বেশিরভাগই আবার ছিল নারী ও শিশু।

মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত ছিলেন এমন অনেকে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। ২৫ আগস্টের পরবর্তী চারদিনে যত গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়, সংখ্যার দিক থেকে তা গতবছরের অক্টোবর-নভেম্বরের চেয়েও বেশি ছিল। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাই বলছে।

আরসা গঠিত হয়েছে তিন বছর আগে। আকারে ছোট ও স্বভাবে চরমপন্থী হওয়ায় দলটির প্রতি খুব কম মানুষেরই সমর্থন ছিল। পাগল না হলে কারো এই ছোট ও অভাবী দলকে সমর্থন করার কথা নয়। কারণ দলটিকে দাঁড়াতে হবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এই সেনাবাহিনী পৃথিবীর ১১ তম বৃহত্তম বাহিনী এবং বহু বছর ধরে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা জারির ইতিহাস আছে এটির।

আইনানুগ কোনো বিকল্প না থাকায়, অনেকেই মনে করেন তারা বাধ্য হয়ে আরসায় যোগ দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের একটি গ্রামের নেতা বলেন, ত্রিশজন যুবক স্বেচ্ছায় আরসায় যোগ দিয়েছে।

‘তাদের হাতে কি অন্য কোনো বিকল্প আছে? তারা ভেড়ার মতো জবাই না হয়ে লড়াই করে মরতে চেয়েছে।’

গত আগস্টে আরসা সমর্থনকারী ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ভিডিওগুলো প্রচারিত হয়েছে সেগুলো মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর চালানো চূড়ান্ত বর্বরতার সাক্ষ্য দিচ্ছে।-নয়াদিগন্ত