রোহিঙ্গা ক্যাম্প: পাহাড়-বন ধ্বংসে ভূমিধসসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা
দেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের কারণে প্রাকৃতিক বন, সামাজিক বনায়নের গাছ কাটা ও পাহাড় ধ্বংসের পাশাপাশি জীববৈচিত্র পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। বর্তমানে বৃষ্টির প্রকোপ না থাকার কারণে কিছু স্বস্তি থাকলেও বর্ষাকালে অথবা হঠাৎ বৃষ্টিপাত হলে ভয়াবহ পাহাড় ধসে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের প্রাণহানি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা।
বন ধ্বংসের হিসেবে কক্সবাজারেই প্রায় সাড়ে চার হাজার একর সংরক্ষিত বন ধ্বংস করে ক্যাম্প স্থাপন করে থাকছে রোহিঙ্গারা। বন বিভাগের হিসাবে শুধুমাত্র সামাজিক বনায়নের গাছের আর্থিক মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। প্রাকৃতিক বনের গাছ হিসাব করলে ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বাড়বে। বন বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
১৯ অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী ১ হাজার ৬৪৫ একর সামাজিক বন ধ্বংস হয়েছে। তবে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত বন ধ্বংসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার একর। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এটা শুধু রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে উজাড় হওয়া সামাজিক বনায়ন ধ্বংসের ক্ষতি। প্রাকৃতিক বন ও পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়বে। বসতি স্থাপন ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে বেশি বন ধ্বংস করা হচ্ছে। বন সংরক্ষক (চট্টগ্রাম অঞ্চল) ড. মো. জগলুল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করা হয়েছে ২ হাজার ৪১৭ একর। বাকি ৮১ একর রক্ষিত বনাঞ্চল। তবে গাছ কাটা হয়েছে শুধু সংরক্ষিত বনাঞ্চলের। বন বিভাগের তিনটি রেঞ্জে বর্তমানে ৫ লাখ ২২ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনে সবচেয়ে বেশি বন ধ্বংস হয়েছে উখিয়া রেঞ্জে।
কুতুপালংয়ে ১ লাখ ৮৬ হাজার রোহিঙ্গার বসতির জন্য ধ্বংস করা হয়েছে এ এলাকার ৫২৫ একর বাগান। বালুখালী এলাকায় ধ্বংস করা হয়েছে ৪৫০ একর বাগান। বর্তমানে সেখানে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এছাড়া উখিয়া রেঞ্জের মক্কারবিল-হাকিমপাড়া-জামতলী-বাগমারা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে। এসব এলাকায় বসতি গড়তে ধ্বংস করা হয়েছে ২০৬ একর বাগান। একই রেঞ্জের তাজনিমা খোলা এলাকায় ১৬২ একর, বালুখালী ঢালা-ময়নারঘোনায় ১৫০ ও শফিউল্লা কাটা এলাকায় সাড়ে ৯২ একর বাগান ধ্বংস করা হয়েছে। এসব এলাকায় বসবাস করছে ১ লাখ ১২ হাজার রোহিঙ্গা। বন বিভাগের হোয়াইকং রেঞ্জের পুটিবুনিয়া, কেরনতলী-চাকমারপুল এলাকায় ৪৪ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এ রেঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৪৯ একর বাগান ধ্বংস করেছে রোহিঙ্গারা। মোট পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার হাজার একর বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গারা তাদের প্রতিদিনের জ্বালানি কাঠের সংস্থান করছে ওইসব বন ধ্বংস করে। গাছ কাটা ছাড়াও গাছের শিকড়ও তুলে ফেলছে পাহাড় থেকে। গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি তারা সেসব কাঠ ক্যাম্পের মধ্যে বিক্রিও করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এসেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর শীর্ষ নেতারা। তারা সরেজমিনে বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে বনায়ন ও পরিবেশের নানা ক্ষতির বিষয়গুলো দেখেছেন।
বাপার যুগ্ম সম্পাদক শাজাহান মৃধা বেনু বলেন, রোহিঙ্গাদের দেশে প্রবেশের ঘটনাটি মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখছি আমরা। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, এরফলে ওইসব (ক্যাম্প এলাকা) অঞ্চলের বন ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। যা কাটিয়ে উঠা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। কুতুপালংয়ের রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতরে হাতির অভয়ারণ্য বলে পরিচিত জায়গাটি এখন প্রায় লাখ রোহিঙ্গার বাস। প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঝরা ও ঝর্ণা মলমূত্র দ্বারা দূষিত।
তিনি আরও বলেন, কুতুপালং, বালুখালিসহ বিভিন্ন ক্যাম্প ছাড়াও রোহিঙ্গারা বিভিন্ন টিলা ও পাহাড়ে অস্থায়ীভাবে আবাস স্থাপন করেছিল। সেখান থেকে প্রশাসন তাদের ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে। ওইসব ফেলে আসা টিলা-পাহাড় প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। পাহাড়ের বিভিন্ন ধাপে জুমসহ মৌসুমি ফসলের ক্ষেতের ফসলেরও ক্ষতি হয়েছে। ওইসব পাহাড়ে আবার সামাজিক বনায়ন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বিরাট প্রাকৃতিক বিপর্যয় হবে বলে আমার ধারণা। আমরা বিষয়গুলো দেখেছি, এ বিষয়ে বাপার পক্ষ থেকে প্রতিকার ও করণীয় সর্ম্পকে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হবে।
বাপার আরেক যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, ঋতু পরিবর্তনের ফলে শীতের কিছুটা আমেজ লক্ষ করা যাচ্ছে। এর ফলে এখন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম, কিন্তু যদি কোনো কারণে বৃষ্টিপাত হলে এখানে পাহাড়ী ঢল ও ভূমি ধসে অনেকের প্রাণহানি হতে পারে। এছাড়া এইসব বনে বাস করা বিভিন্ন প্রাণী ও জীববৈচিত্রের যে ক্ষতি তা এলাকার পরিবেশ ভারসাম্য এবং ফুড চেইনে বড় আঘাত হিসেবে দেখা দিতে পারে।
গাছ কেটে বাড়ি তৈরি করতে সেসব বাড়িতে সাদাকালো পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া অল্প পরিমাণ জায়গাতে প্রচুর মানুষ বাস করলেও গাছ না থাকার কারণে অক্সিজেনের ঘাটতিসহ প্রচণ্ড তাপ লক্ষ করা গেছে, যা বসবাসরত রোহিঙ্গাদের অসুস্থতার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলেও জানান তারা।
বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তিত স্থানীয় পরিবেশ বিভাগের কর্মকর্তারাও। কক্সবাজারের পরিবেশ বিভাগের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশরাফ বলেন, অত্র অঞ্চলের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প গড়ে উঠেছে সেসব এলাকার পরিবেশ বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই অঞ্চলের পাহাড়গুলো অন্যদেশের পাহাড়গুলোর মতো পাথুরে না, বেশির ভাগই বালু ও আঠালো মাটি দিয়ে তৈরি। রোহিঙ্গারা এইসব পাহাড় কেটে রাস্তা, পাকা বাড়ি, মসজিদ-মাদ্রাসা ও বাজার তৈরি করা শুরু করেছে। যার ফলে পাহাড় তার স্বাভাবিক আকার ও স্থায়ীত্ব শক্তি হারাচ্ছে। এরফলে ভবিষ্যতে বড় ধরণের পাহাড় ধস ও পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছি আমরা। এছাড়া স্বাভাবিকভাবে মাটি ছড়ানোর ফলে নিম্ন অঞ্চলগুলোর ফসলি জমি বালুর নীচে চলে যেতে পারে, ঝরা-ঝর্ণার গতিপথ পরিবর্তন হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই এতো লোকের পানি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর আঘাতপ্রাপ্ত হবে। সংরক্ষিত বনের মধ্যে এসব পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও বিষয়টি এখন মানবিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে মেনে নিচ্ছে সরকার।
তিনি আরও বলেন, পরিবেশের এইসব ক্ষতির দিক খতিয়ে দেখতে পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ ও ইউএনডিপি যৌথভাবে একটি জরিপ চালাচ্ছে। যা আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে শেষ করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হবে। যার উপর ভিত্তি করে সরকার স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করবেন বলে আমার ধারণা।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের ঘটনায় গত ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে থাকে রোহিঙ্গারা। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) হিসাবমতে, মিয়ানমার থেকে নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা এরই মধ্যে ছয় লাখ ছাড়িয়েছে। তবে এ সংখ্যা আট লাখের বেশি বলে দাবি স্থানীয়দের। যা দিন দিন আরও বাড়ছে। সূত্র : চ্যানেল আই অনলাইন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন