রোহিঙ্গা সংকটকে কি ভারত উস্কে দিচ্ছে না?
তিব্বতী, শ্রীলংকার তামিল, আফগান বা ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা বাংলাদেশি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাসে রয়েছে ভারতের। শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের ১৯৫১ ও ১৯৬৭ সালের দুই কনভেনশানের একটিতেও স্বাক্ষর না করেও। তাদেরকে জায়গা করে দিয়েছে ভারতে থাকার জন্য।
তবে সম্প্রতি ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের “অবৈধ অভিবাসী” হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে বের করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সেইসাথে নতুন করে কোন রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকেও ঢুকতে দিচ্ছে না ভারত সরকার। এটি দেশটির জন্য নেতিবাচক সেইসাথে শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়ার ঐতিহাসিক অবস্থানকে ঝুকিপূর্ণ করে তোলা। দেশটি এক সময় শরণার্থীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ছিল।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশটিতে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে এবং আরও যারা এখানে প্রবেশের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। মিয়ানমারের কয়েক দশক ধরে সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার এ সম্প্রদায়ের জন্য ভারতের এ অবস্থান আরও পীড়াদায়ক । এ আদর্শিক বা আইনি অবস্থান ভারতের ক্রমবর্ধমান ইসলাম বিদ্বেষকে আরও উস্কানি দিচ্ছে।
শরণার্থীদের প্রতি এ আচরণ মূলত ভারতের মানসিক গোয়ার্তুমি এবং বাইরের লোকদের প্রতি বিদ্বেষকেই ইঙ্গিত করে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোর হিন্দু শরণার্থীদের স্বাগত জানালেও জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে মুসলমান হবার কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য দরজা করে দিয়েছে দেশটি। কিন্তু এই পদক্ষেপটি আন্তর্জাতিক চুক্তি বিরুদ্ধ এবং মানবাধিকার প্রশ্নে সংবিধান বিরোধী।
আগস্টে সশস্ত্র রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দল মিয়ানমারের কিছু নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালালে, দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক অভিযান ও সহিংসতা চালায়। যার কারণে ৪ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার যেইদ রা’দ আল-হুসেইন যথার্থই বলেছেন, রোহিঙ্গারা নিজ দেশে যে সহিংসতার শিকার হচ্ছে সে মূহুর্তে ভারতের বর্তমান আচরণে হতাশা ব্যক্ত করছি।
জাতিগত ও ধর্মীয় কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বর্বরোচিত জাতিগত নিধনের শিকার হচ্ছে তার তথ্য প্রমাণ তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এ জাতিগোষ্ঠীকে হত্যা ও জোরপূর্বক দেশান্তরী করার প্রমাণ পাওয়া গেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। এখন ভারত যদি বর্তমান আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বের করে দেয় তাহলে তাকেও এ ধরণের অভিযোগের সম্মুখীন হতে পারে।
এ পরিস্থিতি পূর্বে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভারত থেকে বের করে দেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়েছে দেশটির সুপ্রীম কোর্ট। কারণ এটি আন্তর্জাতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি – ‘Principle of non- refoulement’ বা আশ্রয়প্রার্থীকে ফিরিয়ে না দেওয়ার বিরুদ্ধে যায়, নিজ ভূমিতে ফেরত গেলে যদি তার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। যদিও জাতিসংঘের কনভেনশানে স্বাক্ষর না করার কারণে ভারত এ নীতি মানতে বাধ্য নয়। কিন্তু এ ধরণের ব্যাখ্যা সঠিক নয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের মতে, ‘Principle of non- refoulement’ নীতি আন্তর্জাতিক আইনেরই একটি অংশ, যেটা রক্ষা করাটা যে কোন দেশের জন্যই স্বাভাবিক কারণ আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে যে কোন দেশ বাধ্য, সে যদি জাতিসংঘের কনভেনশানে স্বাক্ষর না করে থাকে, এরপরেও।
জাতিগত ও ধর্মীয় কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বর্বরোচিত জাতিগত নিধনের শিকার হচ্ছে তার তথ্য প্রমাণ তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এ জাতিগোষ্ঠীকে হত্যা ও জোরপূর্বক দেশান্তরী করার প্রমাণ পাওয়া গেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। এখন ভারত যদি বর্তমান আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বের করে দেয় তাহলে তাকেও এ ধরণের অভিযোগের সম্মুখীন হতে পারে।
দুর্ভাগ্যবশত, শরণার্থী সুরক্ষায় ভারতের নিজস্ব কোন আইন নাই। স্বীকৃত আইন নেই। যদিও বিদেশি নাগরিক বিষয়ক আইন, ১৯৪৬- দ্বারা শরণার্থীদেরকে বিবেচনা করা হয় কিন্তু এ আইনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শরণার্থী, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী, কিংবা অন্যান্য বিদেশি নাগরিকদের কোন পার্থক্য করা হয় না। এ আইনের অধীনে নিয়মবহির্ভূত ছাড়া যে কোন উপস্থিতিকেও অন্যায় হিসেবে ধরা হয়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এর মাধ্যমে ভারতে প্রায় ১৪ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত। যার ফলে শরণার্থী হিসেবে দীর্ঘমেয়াদী ভিসাপ্রাপ্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও গৃহ সুবিধা পেতে এ সব রোহিঙ্গাদের জন্য সহজতর হয়েছে। তবে এখন সব রোহিঙ্গাদের “অবৈধ অভিবাসী” হিসাবে যেভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তাতে এসব নিবন্ধিত রোহিঙ্গারাও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে আসাম এবং মণিপুরে আদেশ জারির মাধ্যমে বলা হচ্ছে, পুলিশের উচিত রোহিঙ্গাদেরকে পুশব্যাক করা। প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী, পুলিশ সেটিই পালন করছে। এর ফলে এখন বিদেশি নাগরিক বিদ্বেষ আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠতে বেশি সময় লাগবে না।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মাত্র এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা বাস করে, মুসলিম সংখ্যালঘু এ সম্প্রদায়টি কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় বৈষম্য এবং সহিংসতার শিকার। ১৯৮২ সালের বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘ কাল ধরে বাস করে আসা এ জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে, সেইসাথে সকল ধরনের নাগরিক অধিকার যেমন স্বাধীনভাবে চলাফেরা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবন নির্বাহের জন্য অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।
গত মাসে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বেশিরভাগ মানুষই বাংলাদেশের নাফ নদী পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের গ্রামে জ্বালিয়ে দিয়েছে, তাদেরকে গুলি করে হত্যা করছে এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে রাখাইনে প্রবেশে বাঁধা দেয়া হচ্ছে। জ্বালিয়ে দেয়া গ্রাম থেকে উত্থিত ধোঁয়া এবং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ধারণকৃত পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া গ্রামের চিত্র দেখেই এখানে কী পরিমান সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হয়েছে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়, যার কারণে বিপুল মানুষ এখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
এই অসভ্যতার বিরুদ্ধে এবং মানুষকে নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে ভারতের আইনগত, আদর্শিক ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে চলে যেতে বাধ্য করা অথবা ভারতে প্রবেশে বাঁধা দেয়া উচিত হবে না এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে ও নিরাপত্তার জন্য সকল ধরণের সামরিক অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ স্থগিত করতে হবে। রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করা, সেই সাথে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়া ও সেখানে মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে মিয়ানমারকে চাপ দিতে হবে ভারতকে।
(আল জাজিরায় প্রকাশিত অরিজিৎ সেনের এ মতামতটি অনুবাদ করেছেন রাফসান গালিব। অরিজিৎ সেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ভারতের সাথে যুক্ত আছেন)
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন