রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে কেন কথা বলেন না মিয়ানমারের নাগরিকরা?
রোহিঙ্গা সঙ্কটের ব্যাপারে মিয়ানমারের নাগরিকদের মনোভাব কী, তা জানতে ইয়াঙ্গুনে গিয়েছিলেন বিবিসি সংবাদদাতা আনবারাসান এথিরাজন। যে ঘটনা সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে, তা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমাজের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে।
ইয়াঙ্গুনে গেলে আপনি টেরই পাবেন না যে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে মাস খানেকেরও বেশি সময় ধরে একটি বড় রকমের মানবিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে। পাঁচ লক্ষেরও বেশী শ রোহিঙ্গা মুসলমান এরই মধ্যে প্রতিবেশি বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে।
এর শুরু ২৫ অাগস্টে- বিদ্রোহীরা পুলিশ চৌকিতে হামলায় চালানোর পর যখন সেখানে সেনা অভিযান শুরু হয়। সহিংসতা বন্ধ করা, রাখাইনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং মানবিক সাহায্য দিতে অনুমতি দেয়ার জন্য বার্মিজ কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ বেড়েই চলছে।
কিন্তু দেশটির সবচেয়ে বড় এই শহরটিতে আপনি দেখতে পাবেন সবকিছু সুস্থির হয়ে রয়েছে। এর রাস্তাঘাট পরিষ্কার, চারপাশ সবুজে মোড়ানো আর রাস্তায় যানজট হলেও সবাই নিয়ম মেনে চলছে। ভালো পোশাক পরা নারী-পুরুষ নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
এখানকার মানুষ রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করে না। গণমাধ্যমে এদের বলা হয় ‘বাঙালি মুসলমান’। কেউ কেউ এদেরকে এমনকি বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ বাঙালি অভিবাসী বলেও বর্ণনা করেন। আনবারাসান এথিরাজন বলেন, যখনই আমি রোহিঙ্গাদের নিয়ে কথা বলতে চেয়েছি, তখন হয় অনেকেই সরাসরি তাদের মত দিয়েছেন কিংবা কেউ কেউ আবার বিষয়টির ওপর এক ধরণের প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন এই বলে যে ‘এই দেশে কথা বলার জন্য অনেক ইস্যু রয়েছে।’
এদের একজন সিনিয়র সাংবাদিক অং লা টুন, যিনি মিয়ানমার প্রেস কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘সমস্যাটা হলো (রোহিঙ্গা) শব্দটির পেছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন আমার অনেক বাঙালি বন্ধু ছিল। তারা কখনো বলতো না যে তারা রোহিঙ্গা… কয়েক দশক আগে থেকে তারা এই শব্দটি ব্যবহার করা শুরু করে।’
“তারা (রোহিঙ্গারা) জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে না। এটিই সত্যি।’ রোহিঙ্গা এবং অন্যান্যরা অবশ্য এই মত মানেন না। রোহিঙ্গা সঙ্কট যখন বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমে বড় শিরোনাম হয়ে চলেছে, তখন এখানকার সংবাদপত্রগুলোয় রোহিঙ্গাদের করুণ অবস্থার বর্ণনা খুব একটা চোখে পড়েনি। যে চরম দুর্দশার মধ্যে তারা বাংলাদেশে বাস করছে তারও বর্ণনা নেই বললেই চলে।
বরং সংবাদপত্রগুলোতে বড় বড় করে ছাপা হচ্ছে যে সেনাবাহিনী ওইসব হিন্দুদের গণকবর খুঁজে পেয়েছে, যারা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা বিদ্রোহীদের হাতে খুন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্ন কোন মেজাজের খোঁজ পাবো কিনা ভাবছিলাম, কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে তাদের সংযোগ আগের প্রজন্মের লোকেদের তুলনায় বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেতে এমন কিছু শিক্ষার্থীকে পাওয়া গেল যারা কথা বলতেই আগ্রহী নয়। অনেকে এমনকি নাম বলতেও চায় না।
কিন্তু যখনই আমি রাখাইন ইস্যুটি তুললাম, খুব দ্রুতই তারা সাড়া দিল। ‘বাইরে থেকে এটিকে একটি ধর্মীয় বিষয় বলে দেখা হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়। এই সহিংসতা মূলত সন্ত্রাস। রাখাইন রাজ্য সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভুল খবর পাচ্ছে- একজন মেয়ে শিক্ষার্থী বললেন।
‘বাইরে থেকে দেখে আপনি মনে করেন যে আপনিই ঠিক। কিন্তু আমাদের দিক থেকে দেখলে আমরাই ঠিক। মেয়েটির দুজন বন্ধুও একই রকম মত দিলেন। কয়েকদিন পরে আমি একটি স্মরণ সভায় গেলাম, যেটির আয়োজন করা হয়েছিল ২০০৭ সালের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনের দশম বার্ষিকী উপলক্ষে।
ওই আন্দোলনে হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু যোগ দিয়েছিলেন, যার কারণে এর নাম দেয়া হয়েছিল ‘স্যাফরন রেভোল্যুশন।’
গেরুয়া বসন পরা ভিক্ষুর সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ছবি তখন পুরো দুনিয়ার নজর কেড়েছিল। দক্ষিণ ইয়াঙ্গুনের একটি মঠে ওই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনকারী আর শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা বড় সংখ্যায় অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এদের অনেকই মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, জেল খেটেছেন।
আমার আশা ছিল রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের কাছ থেকে ভিন্ন কিছু শুনবো। স্যাফরন রেভোল্যুশনের একজন অগ্রণী ছিলেন শোয়ে তুনতে সায়ার ট। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে অল্প দিনের একটি গণতান্ত্রিক দেশ মিয়ানমারের কি উচিত নয় রোহিঙ্গা সহ সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে একই রকম আচরণ করা? তার উত্তর ছিল: ‘গণতন্ত্রে সবাই সমান, একমাত্র সন্ত্রাসীরা ছাড়া।’
‘তারা যদি সন্ত্রাস করে, তবে পুরো বিশ্বের উচিত হবে সন্ত্রাসকে ধ্বংস করা। তা না হলে তারা আমাদের প্রজন্মকে ধ্বংস করবে।’
কোন সন্দেহ নেই যে রোহিঙ্গা মুসলমান ইস্যুর কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অং সান সু চির জনপ্রিয়তা বেড়েছে, যদিও এ বিষয়ে তার নীরবতার কারণে পুরো বিশ্ব তার প্রতি নিন্দায় মুখর হয়েছে। ইয়াঙ্গুনের সিটি হলের বাইরে তার সমর্থনে সমাবেশ হয়েছে।
জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতাকে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান বলে বর্ণনা করেছেন। তবে মিয়ানমার সরকার এই অভিযোগ নাকচ করেছে।
১৯৬০-এর দশকে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পরপরই হাজার হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষকে বার্মা ছাড়তে আদেশ দেয়া হয়েছিল। ওইসব ভারতীয়রা বংশ পরম্পরায় বার্মায় শতশত বছর ধরে বাস করছিল। এদের অনেককেই ১৯ ও ২০ শতকে ঔপনিবেশিক শাসকরা বার্মায় নিয়ে এসেছিল, যখন দেশটি ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল।
ধারনা করা হয়, তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ সে সময় বার্মা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, যাদের বাড়িঘর আর সম্পত্তি পরে জাতীয়করণ করা হয়। এই বার্মিজ ভারতীয় শরণার্থীরা শেষ পর্যন্ত ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। আমি ভাবছিলাম যে ইয়াঙ্গুন আর বার্মার মূলধারার গণমাধ্যম রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপরে চলা সহিংসতার বিষয়টি অস্বীকার করার মত পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে কি-না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ও সাবেক রাজবন্দী আমাকে এর উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সবাই ভয়ের মধ্যে আছে, আর সবাই-ই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চায়। প্রথমত, সেখানে (রাখাইনে) নিরাপত্তার সমস্যা রয়েছে। তাই বেশিরভাগ খবর প্রকাশ হচ্ছে সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাতে।
তিনি আরও বলেন যে এক ধরণের একটি চাপও রয়েছে। তার মতে, আপনি যদি মূলধারার মতামতের বাইরে যান, তাহলে এমনকি আপনার আত্মীয় আর বন্ধুরাও আপনাকে অপছন্দ করবে। বিবিসি বাংলা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন