‘লাশ দাফনের আর জায়গা নেই ঢাকা শহরে!’
গেল বছরের মে মাসে জাতিসংঘের বসতিসংক্রান্ত উপাত্তের বিচারে ঢাকা শহরের অবস্থান হয় বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার ৫০০ জন মানুষ বসবাস করেন।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের ওয়েবসাইটে ঢাকা জেলার প্রতিবেদনে এ জেলার জনসংখ্যা বলা হয়েছে ১ কোটি ২৫ লক্ষ ১৭ হাজার ৩ শত ৬১ জন। তবে বলা হয়ে থাকে বাস্তবে তা আরও বেশি। বিশ্বের অন্যতম এই মেগাসিটি নিয়ে রোববার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। যার শিরোনাম করা হয়েছে: ‘ঢাকা, অ্যা সিটি উইথ নো রুম ফর দ্য ডেড।’
ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরের অধিকাংশ কবরই অস্থায়ী, কারণ এখানে কাউকে কবর দেয়ার জন্য নতুন করে আর জায়গা ফাঁকা নেই। কিন্তু যখন একজনের কবরের উপর আরেকজনকে কবর দেয়া হয় তখন প্রিয়জনের জন্য সেটার অনুভূতি কেমন হয়?
সুরাইয়া পারভীন আর তার বাবার কবর জিয়ারত করতে যেতে পারেন না কারণ সেটি এখন অন্য এক অপরিচিত ব্যক্তির কবর। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘বড় মেয়ে হিসেবে আমিই সবকিছু দেখাশোনা করি। একদিন আমি আমার ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, কয়েকদিনের মধ্যে সে বাবার কবরে গিয়েছে কি না।’
কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত সে জানায় তাদের বাবার কবরের জায়গায় এখন নতুন একটি কবর হয়েছে।
‘নতুন একটি পরিবার এখন ওই কবরের জমির মালিক। কথাটা শুনে মনে হলো আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি।’
সুরাইয়া যখন কথাগুলো বলছিলেন তার দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল।
‘আমি যদি আগে জানতাম তাহলে কবরটা বাঁচানোর একটা চেষ্টা করতে পারতাম। কবরটাই ছিল আমার বাবার শেষ স্মৃতি, আর আমি সেটাও হারিয়েছি।’
কালশির ওই কবরস্থানে তিনি এখনও যেতে পারেন কিন্তু সেখানে তার বাবার কবর আর নেই এবং অন্য একজনকে সেখানে মাটি দেয়া হয়েছে।
এমন ঘটনা সুরাইয়ার সঙ্গে এবারই প্রথম নয়।
একইভাবে তিনি তার এক সন্তান, মা ও আরকে স্বজনের কবর হারিয়েছেন।
একই সমস্যায় আরও অনেকেই তার আত্মীয় ও বন্ধুদের জন্য চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ারে স্থায়ী একটা জায়গা পাচ্ছেন না।
কাউকে কবর দেয়ার জন্য জায়গা খুঁজে পাওয়াটা মোটেও কঠিন কাজ না। অস্থায়ী কবরগুলো বেশ সস্তা। কিন্তু শহরের আইন অনুযায়ী, প্রতি দুই বছরে কবরগুলোতে নতুন কাউকে সমাহিত করা হবে।
তাই অস্থায়ী কবরগুলোতে একাধিক ব্যক্তির মরদেহ দাফন করা হচ্ছে। এভাবেই ঢাকা চলছে।
মানুষজনের কাছে এটা খুব কষ্টদায়ক হলেও তাদের কিছুই করার নেই। কখনও কখনও আত্মীয়-স্বজনদের একই কবরে দাফন করা হয়।
মুসলিম-অধ্যুষিত বাংলাদেশে শবদাহ কার্যকর কোনো পদ্ধতি নয়। স্বাভাবিক অবস্থায় ইসলাম তা সমর্থন করে না।
২০০৮ সাল থেকে স্থায়ী কবর জন্য জমি বরাদ্দ বন্ধ রয়েছে, আর আধা স্থায়ী কবরের জমির জন্য খরচ পড়ে ১৫ লাখ টাকার বেশি; যেখানে এ দেশের মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় গড়ে দেড় লাখের কম।
পুরার ঢাকার কাছে আজিমপুর কবরস্থানে টাকার বিনিময়ে আগাছা পরিষ্কার করে দেন শ্রমিকেরা। আজিমপুর কবরস্থান দেশের বড় বড় কবরস্থানগুলোর একটি এবং হাজারো কবরে সব দিকে এটার সীমানা বাড়ানো হয়েছে।
একেকটি কবরে যাদের দাফন করা হয়েছে কবরের সামনে তাদের বিস্তারিত পরিচয় লেখা থাকে। এ কবরস্থানের প্রতি ইঞ্চি মাটি ব্যবহার করা হয়ে গেছে।
১২ বছর আগে সাবিহা বেগমের বোন আত্মহত্যা করলে তাকে এখানে সমাহিত করা হয়। গত ১০ বছর ধরে সাবিহা তার বোনের কবর রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, আর এর জন্য তিনি যারা এসব দেখাশোনা করেন তাদের ঘুষ দেয়ার কথাও স্বীকার করেছেন।
‘আমার প্রতিদিন ওর কথা মনে পড়ে আর আমি বিশ্বাস করে একদিন সে ফিরে আসবে। আমি মাঝে মাঝে ওর কবরে যায় আর ওর সঙ্গে কথা বলি। নতুন কোনো সিনেমা অথবা গান নিয়ে আমি ওর সঙ্গে কথা বলি। আমার মনে হয়, ও যেন ওই কবরটাতেই আছে। এ কথাগুলো ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন।’
প্রতিবছর তার বোনের কবরে যখন নতুন কাউকে কবর দেয়ার সময় আসে তখন সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক তাকে ফোন করেন। তার বোনের কবরে যেন অন্য কাউকে কবর দেয়া নয় হয় সেটিও ওই তত্ত্বাবধায়কই নিশ্চিত করেন।
সাবিহা বলছেন, ‘আমরা যখন ওর দাফন করেছিলাম তখন জানতাম যে কবরের জন্য স্থায়ী জমি বরাদ্দ দেয়া হয় না। আমার ঠিক মনে নেই… এর ১৮ বা ২২ মাস পর আমাকে ফোন করে জানানো হয় ওই কবরে আরেকজনে কবর দেয়া হবে। সাথে সাথে আমি উপায় খুঁজতে শুরু করি- কিভাবে কবরটি বাঁচানো যায়।’
কবরটা দেখাশোনা করার জন্য আমি যাকে রেখেছিলাম সে জানাল টাকা-পয়সা দিলে কবরটা বাঁচানো যাবে। আর এরপর থেকেই আমি এভাবেই কবরটা টিকিয়ে রেখেছি।
‘প্রতিবছর আগস্ট বা ফেব্রুয়ারি মাসে, যখন ওখানে নতুন কাউকে কবর দেয়ার সময় ঘনিয়ে আসে ওই তত্ত্বাবধায়ক আমাকে ফোন করেন, তখন আমি তাকে মাসিক চুক্তির বাইরেও কিছু টাকা দিয়ে দিই। আর এভাবেই ১২ বছর ধরে আমি কবরটাকে টিকিয়ে রেখেছি।
বাংলাদেশের ধর্মীয় বিদ্বানদের মতে, ইসলামে একটি কবরে একাধিক ব্যক্তির দাফনের অনুমতি রয়েছে। তবে মানুষ চায় যে, তার ভালোবাসর মানুষটিকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছে সেখানে যেন আর কাউকে দাফন না করা হয়।
কিন্তু ঢাকাতে সেটা আর এদকমই সম্ভব নয়, যার যে বিশ্বাসই থাকুক না কেন।
ঢাকার সবচেয়ে বড় ক্যাথলিক গির্জা হলি রোসারিতে খুব সুন্দর করে সবুজ ঘাসগুলো কাটা রয়েছে। পরিপাটি করে আঁকানো রয়েছে ক্রস। গির্জার প্রধান যাজক কমল কোরাইয়া বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে ছিমছাম এ চিত্রপটের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কার একেকটা গল্প।
‘এত বেশি মানুষ প্রতিদিন নতুন করে ঢাকায় ঢুকছে যে এটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা সমাধিগুলোর খুব যত্ন করি। বেশিরভাগ মানুষই গির্জার ভেতরের সমাধিস্থলে সমাধিস্থ হতে চান- কারণ, তারা এটাকে পবিত্র স্থান মনে করেন। কিন্তু আমাদের জমি সীমিত। তাই প্রতি পাঁচ বছর পর পর নতুন কাউকে সমাধিস্থ করতে হয়। আমরা যখন মাটি খুঁড়তে যাই প্রায়ই সেখানে হাড় খুঁজে পাওয়া যায়।
এটাই ঢাকা শহরের কঠিন বাস্তবতা; ৩০০ বর্গকিলোমিটারের সামান্য বেশি আয়তনের যে শহরে দেড় কোটি মানুষের বাস।
ঢাকাতে সাধারণ মানুষের জন্য কবরস্থানের সংখ্যা মাত্র আটটি; যা চাহিদার তুলনায় অতি নগণ্য। এ ছাড়া কয়েকটি পারিবারিক কবরস্থান রয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলছেন, নতুন কবরের জায়গা সংকুলানে এখন মানুষকে নিজ গ্রামের বাড়িতে কবর দিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে এমনকি এর জন্য প্রণোদনার পরিকল্পনাও রয়েছে।
‘ঢাকা শহরে হয়তো এমন অনেকে আছেন যারা তাদের স্বজনদের মহদেহ গ্রামের বাড়িতে দাফন করাতে চান। কিন্তু মরদেহটা সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের জন্য একটা বড় খরচের বিষয় হতে পারে। তাই আমার মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দেব। ধর্মীয় যেসব আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে সেগুলো সারতে আমরা কিছু টাকা-পয়সার ব্যবস্থাও করব। হয়তো এভাবে ঢাকাতে কবর দেয়া থেকে নিরুৎসাহিত হবে মানুষ।’
সমস্যা আরও প্রকট হওয়ার হাত থেকে হয়তো বাঁচাবে এ পদক্ষেপ। কিন্তু সুরাইয়া পারভীন ও তার মতো আরও যারা তাদের প্রিয়জনের চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার স্থানটি হারিয়েছেন তাদের জন্য এটা খুব বেশি শান্তির কোনো বিষয় নয়। কারণ এ বেদনা তাদের বইতেই হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন