শরিকদের যে ৭০ আসন ছাড়ার কথা ভাবছে বিএনপি
বিএনপি এবার একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন জোটভুক্ত দল। আগে থেকেই তাদের সঙ্গে আছে ২০ দল। সেখানে আরও তিনটি দল যোগ দিয়েছে।
এছাড়া এক মাস আগে গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নিয়ে বিএনপি গড়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে বেশ কয়েকজন পোড় খাওয়া রাজনীতিক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিও রয়েছেন তাদের সঙ্গে।
দলের হিসেবে ২৭ টি দলের এই দুটি জোটে। এর প্রধান শরিক রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট (সম্প্রসারিত ২৩ দল)।
দেশে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও ভোটে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
গত সপ্তাহে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগির হিসাব-নিকাশ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে।
ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি দল প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে প্রধান শরিক বিএনপির কাছে জমা দিয়েছে।
বিএনপির কাছ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক আসন খুইয়ে নিতে ভেতরে ভেতরে দরকষাকষিও চলছে শরিক দলগুলোর মধ্যে। যদিও জোটের নীতিনির্ধারকরা বলছেন- এ বিষয়ে আরও পরে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শতাধিক আসন তারা দাবি করেছে বিএনপির কাছ থেকে।
জোটের শরিক দলগুলো যেসব আসন দাবি করেছে, সেগুলোর কোনো কোনোটিতে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থীও রয়েছেন। শুধু তাই নয়, জোটের একাধিক দলের হেভিওয়েট প্রার্থীও আছেন একই আসনে।
এসব নিয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে এক দশক ধরে নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে থাকা বিএনপিকে।
আসন ভাগাভাগিতে জোট ও ফ্রন্টের শরিকদের ছাড় দিতে গিয়ে দলের পোড় খাওয়া নেতাদের কিভাবে সামাল দেবেন, এটিই এখন বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বড় মাথাব্যথার কারণ।
বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল শতাধিক আসন দাবি করলেও তারা সর্বোচ্চ ৫০-৬০ আসন ছাড়তে পারেন।তবে উইনেবল প্রার্থী হলে ৭০ টি আসন ছাড়তেও প্রস্তত বিএনপি।
যেসব আসনে বিএনপির এবং জোটের একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন, সেখানে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। জোটকে ম্যানেজ করা না গেলে ওইসব আসনে বিএনপির প্রার্থীকে বসিয়ে দেয়া হতে পারে।
যোগ্য প্রার্থী পেলে আসন ছাড়তে প্রস্তুত থাকবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই বড় শরিক দলটি। বিএনপি বলছে, জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী থাকলে শরিক দলগুলোকে আসন ছাড়তে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
২০ দলীয় জোটে বিএনপিকে আসনের বড় একটি অংশ ছাড়তে হবে জামায়াতের জন্য। নির্বাচন কমিশন থেকে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে। তবে দলটি বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করেই নির্বাচন করবে।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে জামায়াতের।কারণ সারাদেশে থাকা জামায়াতের ভোট ব্যাংক পুরোপুরি নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে দলটি।
এ জোটটিতে এলডিপি, খেলাফত মজলিস, বিজেপি, কল্যাণ পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামিকে কিছু আসন দিতে হবে বিএনপির।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা দুই জোটের শরিকদের আসন বণ্টন নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছেন। তারা ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোটের শরিকদের ৫০-৬০ আসন ছাড়তে চান। এর মধ্যে জামায়াতকে ২০ আসন ছাড়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
বিএনপির সূত্র জানায়, ২০ দলের শরিক জামায়াতে ইসলামী একাই ৬০ আসন চায়। এর পরের চাহিদা অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। তারা বিএনপির কাছে ইতিমধ্যে ৩০ আসনের জন্য একটি তালিকা দিয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২০ দলের অন্যতম শরিক এলডিপির চাহিদা ১৫-২০ আসন। কিন্তু বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ৫-৬ আসন এলডিপিকে দেয়ার কথা ভাবছে।
এর মধ্যে এলডিপির সভাপতি অলি আহমেদ (চট্টগ্রাম-১৪), মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ (কুমিল্লা-৭), আবদুল করিম আব্বাসী (নেত্রকোনা-১) ও শাহাদাত হোসেন সেলিমকে (লক্ষ্মীপুর-১) জোটের প্রার্থিতার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
২০ দলের অন্য শরিকদের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) আন্দালিব রহমান পার্থ (ভোলা-১), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) শফিউল আলম প্রধানের মেয়ে তাসমিয়া প্রধান (পঞ্চগড়-২), মসিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের রীতা রহমান (নীলফামারী-১) ও মাইনরিটি জনতা পার্টির সুকৃতি কুমার মণ্ডলও (যশোর-২) জোটের মনোনয়ন পেতে পারেন বলে আলোচনা আছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম এবং খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামকে একাধিক আসনে ছাড় দেয়া হতে পারে।
বিএনপি উচ্চপর্যায়ের সূত্রে জানা যায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দলগুলোর মধ্যে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে ঢাকা-১০, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুকে ঢাকা-৭ ও নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরীকে ঢাকা-৬ আসনে প্রার্থী করার চিন্তাভাবনা চলছে।
তবে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু চাচ্ছেন ঢাকা জেলার দুটি আসনে নির্বাচন করতে। ওই দুটি আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক আ স ম রবকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন থেকে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। আর তার দলের তানিয়া রব চাইছেন ঢাকার একটি আসন থেকে নির্বাচন করতে। আ স ম রব আরও কয়েকটি আসনে দলীয় প্রার্থী দিতে চাইছেন।
ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-৭ আসনে মনোনয়ন দেয়ার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। তবে নাগরিক ঐক্যের ভাবনায় রয়েছে অন্তত ৪-৫টি আসন।
জানা গেছে, কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর চাওয়া অন্তত তিন আসন। এর মধ্যে টাঙ্গাইলে দুটি ও গাজীপুরের একটি আসনে নির্বাচন করতে চাইছে তার দল।
টাঙ্গাইলের (৪ ও ৮) আসনের একটিতে কাদের সিদ্দিকীকে প্রার্থী করা হতে পারে। তার ছোট ভাই মুরাদ সিদ্দিকী চাচ্ছেন গাজীপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচন করতে।
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মোহাম্মদ মনসুর মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচন করবেন এটি মোটামুটি নিশ্চিত।
আর বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন বলে জানা গেছে।
জোটসূত্রে জানা গেছে, ২০–দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো যার যার মতো করে নিজেদের চাহিদার তালিকা তৈরি করছে, যা বিএনপিসংশ্লিষ্ট নেতাদের হাতে দিচ্ছে।
এর মধ্যে শরিক দলগুলোর মধ্যে যোগ্য প্রার্থী কে কোন আসনে আছেন, সে বিষয়ে বিএনপিও খোঁজখবর নিচ্ছেন। দু–এক দিনের মধ্যে এ নিয়ে শরিকদের সঙ্গে বিএনপি আলাদাভাবে বসবে।
২০–দলীয় জোটের আটটি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। বাকি অনিবন্ধিত দলগুলোর দু–একজন নেতাকে নিয়েও চিন্তাভাবনা আছে বলে জানা গেছে।
গত মঙ্গলবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক হয়। তাতে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা, বৈঠক শেষে এ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন। জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ বিষয়ে আরও পরে আলোচনা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির জেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আসন বণ্টন নিয়ে প্রত্যেক দল ও জোটের সঙ্গে বসতে হবে। তারপর আমরা ঠিক করব।
তিনি আরও বলেন, জোটের শরিক দলগুলো এখন নিজেরা গোছাচ্ছে। বিএনপিও নিজেদের মধ্যে বসে প্রার্থী বাছাই করবে। যেকোনো দলই যোগ্য বা জেতার মতো প্রার্থী পেলে তাঁকে মনোনয়ন দিতে চাইবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন