শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) ছিলেন বাংলাদেশের প্রবাদ পুরুষ
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ)। তিনি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লেখক, কলামিস্ট ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
যুগন্ধর প্রতিভার এই মানুষ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অন্যতম উদ্যোক্তা ও সাবেক চেয়ারম্যান, দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতা, ইবনে সিনা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ইসলামিক স্কলার। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি তার ক্ষুরধার বক্তব্য তুলে ধরতেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন-যাপন করতেন। কর্মজীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা, সততা ও ন্যায়-নীতির কারণে তিনি সর্বমহলে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন। বহুগুণে গুনান্বিত শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) দায়িত্ব পালনে কখনোই ন্যায়-নীতির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি এবং অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি।
শাহ্ আব্দুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানার বিখ্যাত শাহ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
শিক্ষকতার পেশা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৬২ সালে ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান ফিন্যান্স সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। এর মাঝে তিনি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, যেখানে তিনি ভ্যাট চালুর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ, সমাজ কল্যাণ ও সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ছিলেন। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি ভ্যাট ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাবনা দেন সরকারকে, যা রাষ্ট্রের জন্য এক অভাবনীয় সহায়ক বিষয়ে পরিণত হয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আমলা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ব্যাংকিং, শিক্ষা ও সমাজসেবা সেক্টরে তার অবদান অনন্য। তিনি ইসলামিক ইকনোমিক রিসার্স ব্যুরো, বাংলাদেশ ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব থটের স্বপ্নদ্রষ্টাদের অন্যতম। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ভিসি ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। দেশে নানা সঙ্কটকালে তিনি সততা, দক্ষতা ও সফলতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
শাহ আব্দুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) ছিলেন মুখে, কর্মে, অন্তরে এক ও অভিন্ন। তাকে অনুসরণ-অনুকরণ করা গেলে দেশ ও জাতি খুবই উপকৃত হবে। শাহ আব্দুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু কেউ তার কোনো ত্রুটি ধরতে পারেনি।
শাহ আব্দুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) ছিলেন বাংলাদেশের প্রবাদ পূরুষ। তিনি তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখনীর মাধ্যমে দেশ, জাতি ও ইসলামের কল্যাণে আজীবন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবসময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। নারী জাতির অগ্রায়ণ ও মুক্তির জন্য বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে নারীদের আত্মসচেতন করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
শাহ আব্দুল হান্নান সাহেবের (রহীমাহুল্লাহ) সাথে আমার সম্পর্ক ২৮ বছর আগের। ১৯৯৩ সালে প্রথম তাঁর মুখোমুখি হই। আমার অন্তরে এই মানুষটি সেদিনই জায়গা করে নিয়েছিলেন। প্রথম দিনের কথাগুলো আজও মনে রয়ে গিয়েছে৷
মূলত আমার বন্ধুর মতো বরিশাল মেডিকেল কলেজের বড় ভাই ডাঃ আবু খুলদুন আল-মাহমুদ, শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) সম্পর্কে কথা বলতেন। আর তাঁর মাধ্যমেই এই ক্ষণজন্মা পুরুষের সাথে আমার পরিচয় ঘটে।
আমার বাবা আলহাজ্জ্ব কে.এম আবদুল করিম (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন ঝালকাঠী জেলার রাজাপুরস্থ সাতুরিয়া হামিদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। আব্বা ১৯৯১ সালে আমার দাদীর নির্দেশে বদলি হয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। গ্রামের বাড়িতে আসার পরে আব্বার আর্থিক সীমাবদ্ধতা আরো বাড়ে। এছাড়া আমাদের ২ ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ বহন করতে আব্বা হিমশিম খেতে হতো। সেই সময় শাহ আবদুল হান্নান (রহিমাহুল্লাহ) এর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল I তিনি আমার অধ্যয়নের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও বৃত্তি থেকে তহবিল যথেষ্ট ছিল না, তারপরে তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করা শুরু করলেন। আমি সাংবাদিক হিসাবে আমার ক্যারিয়ার শুরু না করা পর্যন্ত তিনি আমাকে অবিরত সাহায্য করেছিলেন।
প্রাথমিকভাবে আমি একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আমার পেশাদার জীবন শুরু হয়েছিল । কিন্তু আমি এই পেশা উপভোগ করিনি।ছোটবেলা থেকেই আমি লেখালেখি ও গনমাধ্যমের সাথে জড়িত। ছাত্রজীবনে বরিশালের স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক প্রবাসী দিয়ে সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি। শাহ আবদুল হান্নান (রহিমাহুল্লাহ) আমাকে সাংবাদিক হিসাবে আমার পেশা পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন আমি একটি দৈনিক পত্রিকায় যোগ দিয়েছি। এর পরে ঢাকায় ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সাল পযর্ন্ত মোহম্মদী নিউজ এজেন্সিতে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। এ সময় ‘চ্যানেল আই’তে বিজনেস ফাইল এবং এটিএন বাংলায় অর্থনৈতিক পরিক্রমা নামে অনুষ্ঠান উপস্থপনা করেছি।
আমার অবশ্যই অন্য একটি ব্যক্তিগত গল্পের কথা উল্লেখ করা দরকার I আমার বিয়ের অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ হলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু অর্থের অপচয় হওয়ায় তিনি খুব অসন্তুষ্ট হন এবং তিনি সরাসরি আমার সমালোচনা করেন।
শাহ আবদুল হান্নানকে (রহীমাহুল্লাহ) যারা কাছে থেকে দেখেছেন, কেবল তারাই বলতে পারবেন তিনি কেমন মানুষ ছিলেন। স্বভাবের মৌলিক কাঠামো ও রকম অন্য আর দশজনের মত নয়। একবারে নির্মোহ, নির্লোভ ও নিরহংকারী বলতে যা বুঝায়। শিক্ষাবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকতা লাভ করেছিলেন। লেখক হিসেবে দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন। যেখানে ঋদ্ধ হতে হয় ভিন্ন এক পাঠ-অভিজ্ঞতায়।
ইস্কাটন গার্ডেন রোডের তাঁর সরকারি কোয়াটারে এবং গোড়ানের বাসায় বহুবার গিয়েছি। একজন সচিবের বাসা, দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। চৌকি কিংবা খাটের এক পাশে মশাড়ী ঝুলছে। খাটের পাশে কম্পিউটারের টেবিল। একটা কাছের চেয়ার। মেঝেতে গাদাগাদি বই। একটা ছোট সোফা। একপাশে ছিড়ে গেছে। অর্ধেকটা বই এর স্তুপে দখল করে নিয়েছে। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন-যাপন করতেন। পরিচয়ের পর থেকে প্রায়ই শাহ আবদুল হান্নানকে (রহীমাহুল্লাহ) ঘিরে এক ধরনের আলোর বিকিরণ অনুভব করতাম।
শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) অবসর জীবনে তরুণদের মাঝে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে পাঠচক্র পরিচালনাসহ নানাবিধ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামিক পন্ডিত তৈরি করার জন্য, তিনি শুরু করেছিলেন দি পাইওনিয়ার I আমি খুব ভাগ্যবান, আমি তার অনেক ক্লাসে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি I তার ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয় পড়ান। তার এই ছাত্র-ছাত্রীরা ইসলামপন্থীদেরকে গোড়ামী মুক্ত করতে সাহায্য করছে। বিজ্ঞানী হাসান শাহিদ, অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এবং অনেকেই তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র।
যখনই তার কাছে যাই, তখনই তার আলোর ভান্ডার থেকে এমন সব আলোর টুকরো নিয়ে ফিরি যা আগে কখনো দেখিনি।২০০৩ সালে লন্ডন আসার পরও যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করেছি।
শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) অর্থনীতি ও সমাজ সংস্কার বিষয়ে আশ্চর্যময় দিক নির্দেশক। প্রতিটি বিষয়ে বাস্তব ও বিজ্ঞান সম্মত যৌক্তিকতা দিয়ে লিখেছেন একের পর এক প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। তাঁর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ধারালো রচনাশৈলী পাঠকের হৃদয় ছুয়েছে। এতে প্রচারের আতিশয্য নেই, বরং আছে নিখাদ অনুভবের আলপনা।
একজন সাংবাদিক এবং মোহাম্মদী নিউজ এজেন্সি (এমএনএ) এর সম্পাদক হিসাবে বহুবার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। গভীর বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাও বর্ণনা করেছেন। মননশীল আলোচক হিসেবে তাঁর কথা বলার ধরণ খুবই আকর্ষণীয়। আলোচনার মাঝে জীবন থেকে নেয়া গল্প বলার ক্ষমতা আজও মনে পড়ে।
মরহুম শাহ আব্দুল হান্নান সাহেবের (রহীমাহুল্লাহ) মায়ের মৃত্যুর পর তিনি বলেছিলেন, “আমার মায়ের প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকার ঔষধ লাগতো। গত দুই মাস আগে তিনি মারা যান। মা মারা যাওয়ার কারণে আমার তো এখন প্রতিমাসে ১৫-২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত থাকার কথা। কিন্তু সে টাকা কই? আমি টাকার কোন হিসাব পাই না।”
কথার সারাংশ হলো- “মানুষ যখন চলে যায়, তার রিজিকের অংশও সাথে করে নিয়ে যায়।”
অর্থাৎ আত্নীয়-স্বজন,পিতা-মাতার রিজিকের অংশ আপনার আয়ের মধ্যেই দেওয়া থাকে। এ রকম না যে, আপনি যদি তাদের জন্য খরচ না করেন, আপনার টাকার অংশ সেভ হবে।
শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) ছিলেন সৃজনশীল মানুষ। প্রভাব বিস্তারকারী লেখক। তাঁর গ্রন্থ সমূহ এবং আত্মজীবনী ‘আমার কাল, আমার চিন্তা’ পড়লে তাকে কিছুটা উপলব্ধি করা যাবে। অন্তরের তাগিদে লেখা। যে ইন্সপাইরেশন বহু মানুষের জীবনে প্রভাবক হয়ে উঠেছিল। লেখাগুলি টেনে নেয় শিকড়ের কাছাকাছি৷ তরুণ প্রজন্ম আত্মপ্রত্যয়ী হয় এই লেখা থেকে। বর্তমানের সাথে অতীতকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ করে দেয় এ লেখাগুলি৷ বহুদিন পরেও তাঁর বইয়ের পাতা ওল্টালে লেখাগুলিকে হয়তো অন্য রঙে আবিষ্কার করবেন পাঠক৷
শাহ আব্দুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ কিছু বই লিখেছেন। সেগুলোর অন্যতম হল-
• ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা
• ইসলামী অর্থনীতিঃ দর্শন ও কর্মকৌশল
• নারী সমস্যা ও ইসলাম
• নারী ও বাস্তবতা
• সোস্যাল ল অব ইসলাম
• দেশ সমাজ ও রাজনীতি
• বিশ্ব চিন্তা
• সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম
• উসুল আল ফিকহ
• ল ইকনোমিক অ্যান্ড হিস্টোরি
শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) ইন্টেলেকচুয়াল পর্যায়ে কাজ করেছেন ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্যে। তখন ইসলামিক ইকোনোমিকস রিসার্চ ব্যুরোর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং ভাবনার ভিত্তি রচনা হয়। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং খাতের অন্যতম পথিকৃত এম আজিজুল হক ছিলেন একাজের অন্যতম নিয়ামক।
ইন্টেলেকচুয়াল ওয়ার্ক, ট্রেনিং ওয়ার্ক ও উদ্যোক্তা সংগ্রহ তিনটিই কাজ চলছিল এক সাথে। তবে উদ্যোক্তা প্রস্তুত না হলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতিকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। কল্যাণমুখী কার্যক্রমের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক সফল হওয়ায় অনেক ব্যাংকই এখন ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকিংয়ে এসেছে। দুটি ব্যাংক প্রচলিত ধারা থেকে ইসলামী পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সারা দুনিয়াতে এ ধারার ব্যাংকিং চালু হচ্ছে। বিভিন্ন বহুজাতিক ব্যাংকও এখন ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে।
অভিনব জীবনবোধের অধিকারী শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে থাকবেন। জীবনকে অনুভবের জন্য তাঁর এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। সমাজ গঠনে আত্মপ্রত্যয়ী এই মানুষটি ছিলেন সফল সাধক। তাঁর চিরায়ত সৃজন-কর্মগুলিকে সমাজ সংস্কারক সহ মানবতাবাদী মানুষ বহুকাল মনে রাখবেন। আমাদের ইতিহাসে ও সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে এই বাস্তবতা প্রখরভাবে উজ্জ্বল।
২০১৪ সালে বিশ্বসেরা ১০০০ ব্যাংকের তালিকায় মনোনীত হয় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’। বৃটেনের শতাব্দী প্রাচীন আর্থিক ম্যাগাজিন ‘দি ব্যাংকার’ বিশ্বের এক হাজার শীর্ষ ব্যাংকের তালিকায় প্রথম বারের মতো বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের নাম অন্তর্ভুক্ত করে।
ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭৪ সালে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) চার্টারে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সহ ২৮টি মুসলিম দেশ। পর্যায়ক্রমে নিজেদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামী মডেলে ঢেলে সাজাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় সে চার্টারে। আর তখন থেকেই ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জাগে তাঁদের মনে।
সরকারি ও বেসরকারি যেকোন ভাবে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পরিকল্পনা তখন থেকেই শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো: মহসীন আইডিবির চার্টার বাস্তবায়নে দুবাই ইসলামী ব্যাংকের আদলে বাংলাদেশে একটি ব্যাংক করা যায় কিনা সে বিষয়ে একটি প্রস্তাব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। ওই প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে যায়। এটাই ছিল ভেতরে ভেতরে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস। তখন তাদের সহায়তা ও প্রেরণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এএসএম ফখরুল আহসান বিভিন্ন দেশের ইসলামী ব্যাংক সমূহ পরিদর্শন করে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাই করে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এতে বাংলাদেশে ইসলামী ধারায় ব্যাংক করা যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী সহ রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের একটি বৈঠক হয়। সেখানে এসব ব্যাংকে ইসলামী শাখা খোলার সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর নুরুল ইসলাম বেসরকারি খাতে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। এরপর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে আইডিবি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেন।
ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হিসেবে তাঁরা তখন ব্যাপক কর্ম তৎপরতা পরিচালনা করেন। আইডিবির নেতৃত্বে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসে কুয়েত ফাইন্যান্স হাউজ, জর্ডান ইসলামী ব্যাংক, কাতারের ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট এন্ড এক্সচেঞ্জ কর্পোরেশন, বাহরাইন ইসলামী ব্যাংক, লুক্সেমবার্গের ইসলামিক ব্যাংকিং সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং এসএ, সৌদি আরবের আল-রাজী কোম্পানি ফর কারেন্সি এক্সচেঞ্জ এন্ড কমার্স, দুবাই ইসলামী ব্যাংক সহ বহু বিদেশী ব্যাংক ও ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট।
পর্যায়ক্রমে যুক্ত হয় কুয়েতের পাবলিক ইনস্টিটিউশন ফর সোস্যাল সিকিউরিটি, মিনিস্ট্রি অব আওকাফ এন্ড ইসলামিক এ্যাফেয়ার্স এন্ড মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস, ডিপার্টমেন্ট অব মাইনরস এ্যাফেয়ার্স সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এতে আরো যুক্ত হন সৌদি আরবের সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী আহমদ সালাহ জামজুম এবং ওআইসির তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতীব। আল্লাহর রহমতে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসলামী ব্যাংকের কর্ণধারদের কথা স্মরণ করে শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্ণর এবং পূবালী ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম খালেদ ছিলেন প্রথম উপদেষ্টা। শিল্প ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম এ করিম ছিলেন প্রথম এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট। সোনালী ব্যাংক থেকে এসে যোগ দেন আযীযুল হক ও এএফএম গোলাম মোস্তফা। অগ্রণী ব্যাংক থেকে ইউসুফ চৌধুরী। তাদের নিয়ে প্রথম ব্যবস্থাপনা টিম কাজ শুরু করে। এছাড়া শীর্ষ নির্বাহীদের মধ্যে কাজ করেছেন সোনালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর লুৎফর রহমান সরকার, অগ্রণী ব্যাংক থেকে এসে যোগদানকারী কামাল উদ্দীন চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আবদুর রকিব প্রমুখ।
শাহ আব্দুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) যে ব্যক্তিত্ব নিয়ে অফিস পরিচালনা করতেন এবং যে সততা নিয়ে উঁচু উঁচু করে চলতেন; যে বিশ্বাস-জ্ঞান-মেধা-আধুনিকতা ও আন্তরিকতা নিয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলতেন তার ফলে কোনো দুর্নীতিবাজ, ধান্ধাবাজ-দলবাজ তার সামনে দাঁড়াতে সাহস পেত না।
গত ৮ মে থেকে তিনি হাপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময় একাধিকবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন তিনি। একইসঙ্গে মস্তিষ্কে প্রদাহের কারণে স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। বুধবার (২ জুন) সকাল সোয়া ১০টার দিকে ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)।
শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) এক ছেলে, এক মেয়ে, তিন ভাইসহ অনেক আত্মীয় স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
তার ইন্তেকালে জাতি একজন প্রতিথযশা অর্থনীতিবিদ এবং উদার মনের ইসলামিক ব্যক্তিত্বকে হারালো। তিনি গণমানুষের কল্যাণ ও সমাজসেবায়ও ছিলেন কর্মতৎপর ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যুতে দেশের বুদ্ধিভিত্তিক আদর্শ চর্চার অঙ্গণে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহজেই পূরণীয় নয়। কীর্তিমান এই মানুষটি তার কর্মের মাধ্যমেই দেশবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
মরহুম তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যম ইসলামের সুমহান আদর্শকে উচ্চকিত করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি তার লেখনীতে সমকালীন যুগজিজ্ঞাসার জবাবে বেশ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘’ইসলামের মূল জিনিস পরিত্যাগ করে ছোট-খাটো ব্যাপার নিয়ে মুসলমানরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের তৈরি বিভিন্ন কিতাবের ওপর নির্ভর করছে। আল্লাহর মূল কিতাবকে সেই তুলনায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ইসলামকে যদি ইসলামের মূল পাঠ্য ও উৎসের বাইরে থেকে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে তা হবে স্পষ্ট ভুল। অনেকে কোরআনের অনুবাদে নিজেদের কথা ঢুকিয়ে দেয়। ফলে পাঁচ-ছয়টি বই পড়লে বুঝা যাবে, কোথায় মানুষের কথা ঢুকেছে; আর প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বক্তব্য কি। কয়েক রকম ব্যাখ্যা পড়লে পাঠক ঠিক করতে পারবেন কোন ব্যাখ্যাটা সঠিক।’’
শাহ আব্দুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) সবসময় অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তার সারল্য, চরিত্রমাধুর্য্য ও ব্যক্তিত্ব ছিল খুবই হৃদয়গ্রাহী, আকর্ষণীয় ও অনুকরণীয়। আর্থিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সততার যে নজির শাহ আবদুল হান্নান (রহীমাহুল্লাহ) রেখে গেছেন, তা বিরল। তাঁর শেষ ঠাঁই ছিল পিতা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভাইবোনদের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় উত্তর গোড়ানে গড়ে তোলা বাড়ি।
এদেশে সততার খুব অভাব। দুর্নীতি, অন্যায়, অনাচার ও বৈষম্যমুক্ত শান্তিপূর্ণ একটি সমাজ গড়তে হলে শাহ আব্দুল হান্নানের (রহীমাহুল্লাহ) মতো ভালো মানুষদের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োজন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকে আমাদের সমাজে এর সম্পূর্ণ বিপরীতটা হচ্ছে। গুণী, মোধাবী তথা ভালো মানুষদের আজ কোণঠাসা করে রাখা হয়।
আমি তার ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তার শোক-সন্তপ্ত পরিবার-পরিজন ও সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। মাহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন। তার নেক আমলসমূহ কবুল করুন। তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে সিদ্দিকিন-সালেহীনদের সাথে অন্তর্ভূক্ত করে নিন।
লেখক :
ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম,
কলামিষ্ট, সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন