শেষ কর্মদিবসে আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকারের শেষ কার্যদিবস ছিল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার ও শনিবার (২৯ ডিসেম্বর) দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটি এবং নির্বাচনের কারণে রোববার (৩০ ডিসেম্বর) সাধারণ ছুটি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের এ মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে নিজ কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার (২৭ ডিসেম্বর) অফিস করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে আনুষ্ঠানিক বিদায়ও নেন। বিদায় বেলা বক্তব্য দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে অফিস করেননি মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য। প্রায় সবাই নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের মন জোগাতে কাজ করেছেন।

নিজ কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে তারাই সরকার গঠন করবে। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হয়েছে তার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, এ উন্নয়নের ধারা বহাল রাখতে হবে। সরকার ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ ঘোষণা করেছে। এছাড়া এ সময়ে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত অবস্থায় আমরা মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে চাই।

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, মহাপরিচালক বেগম নাসরিন আফরোজ, প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, এসএসএফের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মুজিবুর রহমান, প্রটোকল অফিসার খুরশীদ আলম, সহকারী পরিচালক মো. মকবুল হোসেন অনুষ্ঠানে অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন।

প্রধানমন্ত্রী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি কিন্তু নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চিন্তা করি না। আমি হচ্ছি বাবার কন্যা ‘ফাদারস ডটার।’ সন্তান হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করি। আমি জাতির পিতার কন্যা। আমি আপনাদের কাছে এটুকুই চাইব, আপনারা সবসময় আমাকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা হিসেবেই আপনাদের একান্ত আপনজন হিসেবে দেখবেন। সেটাই আমি চাই। সেটাইতেই আমি গর্বিত বোধ করি, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রিত্ব, এটা একটা দায়িত্ব পেয়েছি। কাজ করার সুযোগ পাই এর মাধ্যমে। দেশের কল্যাণ করার একটা সুযোগ পাই। সেটাই আমার কাছে বড়।’

তিনি সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘১০ বছর একটানা থাকায় অনেক কাজ করে যেতে পেরেছি। এখনও বহু কাজ বাকি। সেটাও নির্ভর করে বাংলাদেশের জনগণের ওপর। ৩০ তারিখে যদি তারা ভোট দেয়, তাহলে আবার আসতে পারব এবং কাজগুলোকে শেষ করতে পারব। আর তা না হলে মানুষের ভাগ্য মানুষ বেছে নেবে। এখানে আমার কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ নেই। কেননা, আমার নিজের জীবনে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই,’-বলেন শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য গড়াই তার একমাত্র চাওয়া উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি একথা সব সময় চিন্তা করি যে, আমার বাবা এদেশটাকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। তার মনে যে আকাঙ্ক্ষা ছিল মানুষকে নিয়ে, সেই আকাঙ্ক্ষা যেন আমি পূরণ করে যেতে পারি। যেন তার আত্মা শান্তি পায় বাংলাদেশের মানুষ আজ আর কষ্টে নেই, তারা দু’বেলা পেট ভরে খেতে পারছে।’

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বলেন, ‘১০টি বছর আপনাদের সঙ্গে কাজ করেছি, আমরা হচ্ছি টেম্পোরারি, আপনারা পার্মানেন্ট। আমরাতো ৫ বছরের জন্যই নির্বাচিত হয়ে আসি।’ তিনি বলেন, ‘আমার সৌভাগ্য যে, আমরা দ্বিতীয়বার আসতে পেরেছি। তাই আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আজ দৃশ্যমান হয়েছে। আমাদের এ শাসনামলে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন হয়েছে।’

মঙ্গা পীড়িত দেশের উত্তর জনপদের উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ উত্তরবঙ্গে আমি বহুবার সফর করেছি। কিন্তু এবার যখন উত্তরবঙ্গে গেলাম তাদের জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি।’ মানুষের জীবনমানের আরও উন্নয়ন করাই তার সরকারের আগামী দিনের লক্ষ্য উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এজন্য আমরা নির্বাচনী ইশতেহারে প্রত্যেকটি গ্রামকে শহর হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছি, যাতে সব ধরনের নাগরিক সুবিধাগুলো গ্রামের মানুষ পেতে পারে।’

তার সরকার উন্নয়নের সমতায় বিশ্বাসী উল্লেখ করে সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে দলিত হরিজন শ্রেণীর জন্যও ফ্ল্যাট করে দেয়ার সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এভাবে বস্তিবাসীর জন্য আমরা ফ্ল্যাট করে দেব এবং সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেই যেন একটা সুন্দর জীবন পায়, সেটা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। কোনো মানুষ অবহেলায় থাকবে না।’

বিভিন্ন পেশার অধস্তন কর্মচারীদের পদ পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নাম পরিবর্তন আমি এজন্য করলাম কারণ, তাদের ছেলেমেয়ে যখন শিক্ষিত হয়, তখন তাদের নাপিত বা সুইপার বলা অসম্মানজনক হয়। তাছাড়া, এখন একটু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই তারা কাজগুলো করতে পারে। তাই, এসব পদবি পরিবর্তন করলাম।’

তিনি বলেন, ’৯৬ সালে যখন সরকারে তখন সেনাবাহিনীর অধস্তনদের পদবিটা পরিবর্তন করে দিয়েছি। এরপর আমাদের প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যারা কাজ করেন, তাদের সম্মানজনক একটা পদবি যেন হয় তার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কিছু ব্রিটিশ আমলের পদবি ছিল যেগুলো থাকার কোনো যৌক্তিকতাই ছিল না।’

সব ধর্মাবলম্বীর বাসস্থল এ বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ যেন একটি উৎসব একত্রে উদযাপন করতে পারে, সেই চিন্তা থেকেই নববর্ষে ভাতার ব্যবস্থা করেছেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নববর্ষটা যেন সবাই মিলে উদযাপন করতে পারে, সেজন্য আমরা বৈশাখী ভাতার ব্যবস্থা করেছি। যাতে সবাই মিলে নতুন বছরটি ভালোভাবে উদযাপন করতে পারে। আমরা আগামীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। ধনী-দরিদ্রের এ ভেদাভেদটা থাকবে না। আয়-বৈষম্যটা কমিয়ে এনে সবাই যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারে, সেই ব্যবস্থাটাই আমরা করতে চাই।’

বিদায় বেলায় কবি সুকান্তের ভাষায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘চলে যাব, তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এই আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

পরে প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ের মেইন গেটের সামনের দেয়ালে স্মৃতিময় ১৯৫২ থেকে ’৭১-এর মুক্তিসংগ্রাম পর্যন্ত বাঙালির গৌরবের ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি টেরাকোটার ম্যুরাল পরিদর্শন করেন। এ ম্যুরালের ভাস্কর ছাত্রলীগ নেতা মুহম্মদ আরিফুজ্জামান নুর নবী।