সবার আগে শিশু অধিকার

প্রতিটি শিশুই সুন্দর এই পৃথিবীতে সুস্থ-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার ও বেড়ে ওঠা, তার দৈহিক ও মানসিক বিকাশ তথা খাদ্য-পানীয় পুষ্টি, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা-বিনোদন, নিরাপত্তার ও সুরক্ষার অধিকার নিয়ে ভূমিষ্ট হয়। শিশুর এ অধিকারগুলো নিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব মা-বাবা, পরিবার-পরিজন, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। আজকের শিশুই আগামী দিনের নাগরিক দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। এ সত্যকে উপলব্ধি করেই শিশুর যথাযথ যত্ম, নিরাপত্তা, সুরক্ষাসহ অন্যান্য অধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘শিশু অধিকার’ ঘোষণা করা হয়।

শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শিশু অধিকার সনদে ৫৪টি ধারা এবং ১৩৭টি উপ-ধারা রয়েছে। এই উপ-ধারাগুলোতে শিশুদের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের বৈষম্য থেকে বিরত থাকা, শিশুদের বেঁচে থাকা ও বিকাশের অধিকার, নির্যাতন ও শোষণ থেকে নিরাপদ থাকার অধিকার, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে পুরোপুরি অংশগ্রহণের অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো বর্ণিত রয়েছে। সনদে বর্ণিত প্রতিটি অধিকার প্রত্যেক শিশুর মর্যাদা ও সুষম বিকাশের জন্য অপরিহার্য। স্বাস্থ্য পরিচর্যা, শিক্ষা ও আইনগত, নাগরিক ও সামাজিক সেবা প্রদানের মান নির্ধারণের মাধ্যমে এ সনদ শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে। শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ বিবেচনা করে যাবতীয় নীতি প্রণয়ন ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে দায়বদ্ধ। শিশু অধিকারের ঘোষণার ঠিক ত্রিশ বছর পর ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে একটি শিশু অধিকার সনদ অনুমোদন করা হয়। এর ধারাগুলোতে প্রতিটি শিশুর অধিকার উন্নয়নে মূলত শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার, বিকাশের অধিকার, সুরক্ষার অধিকার এবং অংশগ্রহণের অধিকার এই ৪টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

শিশু সনদের মূলনীতি চারটি। বৈষম্যহীনতা, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ, শিশু অধিকার সমুন্নত রাখতে পিতা-মাতার দায়িত্ব এবং শিশুর মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এর আওতার্ভুক্ত। একটু বিশদভাবে বললে বৈষম্যহীনতা বলতে সকল শিশুর লিঙ্গ, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্ম, ভাষা, জাতীয়তা, গোত্র, বর্ণ, শারীরিক সামর্থ অথবা জন্মের ভিত্তিতে কোনোরকম বৈষম্য ছাড়াই সনদে বর্ণিত অধিকারসমূহ ভোগের অধিকার রয়েছে।

বাংলাদেশে শিশুর অধিকার পূরণের অভাব এবং শিশুদের নানা ঝঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘনবসতি, সীমিত সম্পদ এবং ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংসারে অভাব অনটন শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য করে। এতে তাদের শিক্ষাজীবন নষ্ট হয়ে যায়। শিশুজীবনের সব রঙিন স্বপ্ন ও কল্পনা ধূসর হয়ে যায়, অপমৃত্যু ঘটে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার। বিভিন্ন কলকারখানা, খেতখামার, বাসাবাড়িতে তারা কাজ করে এবং অনেক সময় ঠিকমতো পারিশ্রমিকও পায় না। শুধু পেটভরে ভাত পেলেই তারা সন্তুষ্ট থাকে। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর হাতে সামান্য অপরাধের জন্য তারা চরম নির্যাতনের শিকার হয়। এমনকি গৃহকর্মীর মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়। এসব ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে মেয়েকর্মীরা নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, যা তাদের শিশুমনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। এরমধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ শিশু দরিদ্র। এই দরিদ্র শিশুদের মধ্যে রয়েছে শ্রমজীবী শিশু, গৃহকর্ম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, শিশুবিয়ের শিকার শিশু এবং চর, পাহাড় আর দুর্গম এলাকায় বসবাসরত শিশু। ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্ত, সুস্বাস্থ্য, মানসম্মত শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মতো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উন্নয়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

-২-

শিশু অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। বাংলদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নীতির মৌলদর্শ বর্ণনায় শিশুর অধিকারের প্রাসঙ্গিক বিধান এবং মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষিত রয়েছে। সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩১ অনুচ্ছেদে সবধরনের বৈষম্য থেকে শিশুর নিরাপত্তা বিধানের সাধারণ নীতিমালার উল্লেখ রয়েছে। এসব অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান ও অভিন্ন নিরাপত্তা লাভের অধিকারী বিধায় পক্ষপাতহীনভাবে তাদের আইনের সুযোগ লাভের অধিকারও রয়েছে।

দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের শিশুদের উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরকারিভাবে শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান, যেমন শিশু একাডেমি, খেলাঘর, শাপলা-শালুক, কচি কাঁচার আসর ইত্যাদি। তাছাড়া প্রচার মাধ্যমগুলোও শিশুদের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে, যেমন মিনা কার্টুন, সিসিমপুর ইত্যাদি। এসব অনুষ্ঠান যেমন বিনোদনধর্মী তেমনি শিক্ষামূলকও বটে। এছাড়া বেশকিছু বেসরকারি সংস্থাও গড়ে ওঠেছে ঝরেপড়া কর্মজীবী শিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য অধিকার প্রদানের জন্য।

স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রথম ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করেন। এর ১৫ বছর পর জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ প্রণয়ন করে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরে বর্তমান সরকার শিশুর অধিকার ও সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতির ফলে মা ও শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে এবং এমডিজির লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষায় অগ্রগতি, শিক্ষায় লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস, উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, শিশু বিকাশকেন্দ্র স্থাপন, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন, শিশুর প্রারম্ভিক মেধা বিকাশ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের যথাযথ বিকাশের জন্য নেয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় গত এক দশকে শিশুর উন্নয়ন ও সুরক্ষায় বিভিন্ন যুগান্তকারী আইন, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩, শিশু অধিকার আইন ২০১৩, ডিএনএ আইন ২০১৪, পারিবারিক সহিংসতা আইন ২০১০, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন ২০১৮ উল্লেখযোগ্য।

বছরের প্রথম দিনেই দেশব্যাপী সকল শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া, ছাত্রী উপবৃত্তি, বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল চালু করার যুগান্তকারী কার্যক্রমও বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে শিশুর ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। শিশুদের যথাযথ বিকাশ ও দক্ষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে তুলতে স্কুলগুলোতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। শিশুর পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, শিশু নির্যাতন এবং শিশু পাচার রোধসহ শিশুর সামগ্রিক উন্নয়নে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেছে।

শিশুরা জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। দেশপ্রেমিক ও কর্মক্ষম ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন কৌশল আজ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের জন্য মডেল। আজকে যে শিশু বা কিশোর, আগামী দিনে সেই হবে এ উন্নয়ন কৌশলের মূল চালিকাশক্তি। এই শিশু কিশোরদের আধুনিক সমাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে সর্বাগ্রে।