সরকারের চাপের মুখে দেশত্যাগ করতে হয়েছে : এসকে সিনহা
বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) একটি আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশ করেছেন, যেখানে তিনি দাবি করছেন- তাকে সরকারের চাপ এবং হুমকির মুখে দেশত্যাগ করতে হয়েছে।
বিচারপতি সিনহার সদ্য প্রকাশিত বই ‘এ ব্রোকেন ড্রিম : রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ এখন আমাজনে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। এ বইতে বিচারপতি সিনহা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন কোন পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়েছিল এবং কিভাবে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। তারপর কেন তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। তিনি দাবি করেন, হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের মুখে তিনি দেশ ছেড়েছেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ নিয়ে বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। গত বছরের নানা নাটকীয় ঘটনাবলীর পর কোনো গণমাধ্যমে এটিই ছিল তার প্রথম সাক্ষাৎকার।
বিচারপতি সিনহা দাবি করছেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি যেন সরকারের পক্ষে যায়, সেজন্য তার ওপর ‘সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে চাপ তৈরি করা হয়েছিল।’ বিচারপতি সিনহার বইয়ের একটি মুখবন্ধ রয়েছে, যাতে তিনি সংক্ষেপে ‘বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব’ বর্ণনা করেছেন এবং তার ভাষায় কী পরিস্থিতিতে তিনি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ করে বিদেশে গিয়েছিলেন, তা লিখেছেন।
২০১৭ সালে সিনহার পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত একটি মামলার আপিলের রায়কে কেন্দ্র করে। রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সরকারের কাছ থেকে প্রচণ্ড চাপের মুখে বিচারপতি সিনহা দেশ ছেড়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।
আমাজনে প্রকাশ করা বইটিতে ‘বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্বের বিস্তারিত বর্ণনা এবং আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার’ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে বলে বিচারপতি সিনহা ভূমিকায় উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশের পার্লামেন্টে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের ইমপিচ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে পার্লামেন্টের সদস্যদের দেয়ার পর ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বিশেষ বেঞ্চ ওই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করে এবং সাত সদস্যের একটি বেঞ্চে আপিলের শুনানি হয়।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার বইতে লেখেন- ‘জুলাইয়ের ৩ তারিখ প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সভাপতিত্বে সুপ্রিমকোর্ট বেঞ্চ আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বহাল রাখেন। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ১ তারিখ সর্বসম্মত রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়।’ সেখানে তিনি লেখেন- ‘ওই সিদ্ধান্তের পর সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করে’ যাতে সেই রায়কে বাতিল করার জন্য আইনি পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়।’
বইটির মুখবন্ধের কিছু অংশে সিনহা লেখেন- ‘প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের অন্যান্য সদস্য ও মন্ত্রীরা পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে যাওয়ায় আমার কঠোর নিন্দা করেন। প্রধানমন্ত্রীসহ কেবিনেট মন্ত্রীরা আমার বিরুদ্ধে অসদাচরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ এনে বদনাম করতে শুরু করেন। আমি যখন আমার সরকারি বাসভবনে আবদ্ধ, আইনজীবী এবং বিচারকদের আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না, তখন সংবাদমাধ্যমকে বলা হয়- আমি অসুস্থ, আমি চিকিৎসার জন্য ছুটি চেয়েছি। একাধিক মন্ত্রী বলেন, আমি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাব। অক্টোবরের ১৪ তারিখ, যখন আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই- তখন একটি প্রকাশ্য বিবৃতিতে আমি পরিস্থিতি স্পষ্ট করার চেষ্টায় একটি বিবৃতি দেই যে, আমি অসুস্থ নই এবং আমি চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি আশা করছিলাম যে, আমার প্রত্যক্ষ অনুপস্থিতি এবং আদালতের নিয়মিত ছুটি- এ দুটো মিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সহায়ক হবে এবং শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সরকার ওই রায়ের যে মর্মবস্তু- অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর, তা বুঝতে পারবে। শেষ পর্যন্ত ভীতি প্রদর্শন এবং আমার পরিবারের প্রতি হুমকির সম্মুখীন হয়ে আমি বিদেশ থেকে আমার পদত্যাগপত্র জমা দেই।’
বিচারপতি সিনহা লেখেন- তার এ বইতে তার ব্যক্তিগত ও বিচার বিভাগে কর্মজীবনের কথা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রতি চালেঞ্জগুলো, বিচারবিভাগ ও রাজনীতিবিদদের মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পুলিশের বাড়াবাড়ি, জরুরি অবস্থার প্রভাব এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের বিবরণ আছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন