সাইপ্রাসের শরণার্থী ক্যাম্পের গেটে ছয়দিন ধরে দাঁড়িয়ে তিন বাংলাদেশি

সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোসিয়ায় অবস্থিত পুরনারা শরণার্থী ক্যাম্পে বর্তমানে দুইশর অধিক বাংলাদেশি রয়েছেন৷ অনেকেই আবার আশ্রয়ের আশায় দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাম্পের সামনে৷
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন৷ চেহারায় স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ আর চোখে-মুখে অসহায়ত্ব৷ সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোসিয়ার শরণার্থী ক্যাম্পটির গেটের এক পাশে গত ছয়দিন ধরে দিন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তারা৷

ভাষা শুনে বুঝা যায় তারা বাঙালি৷ জানালেনও তাই- বাংলাদেশ থেকে এসেছেন৷ দালালদের হাত ধরে কাজের সন্ধানে এসেছেন সাইপ্রাসে৷ কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে ভিনদেশিদের কাছে নিজের পরিচয় দেওয়ার জন্য যে পরিচয়পত্র দরকার সেটিও নেই৷ মূল পাসপোর্টি ‘দালালেরা’ নিয়ে গেছে৷ হাতে একটি ফটোকপি নিয়ে গেটের সামনে অপেক্ষা করছেন, যদি ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ আশ্রয় দেয় সেই আশায়৷

ক্যাম্পের সামনে ডয়চে ভেলের সাংবাদিকদের সাথে কথা হয় বাংলাদেশি এই আশ্রয়প্রার্থীদের৷ তাদের একজন সেলিম হোসেন৷

জানালেন, বাংলাদেশের পাবনা জেলায় বাড়ি তার৷ দালালদের হাত ধরে কাজের সন্ধানে এসেছেন সাইপ্রাসে৷ কিন্তু উত্তর সাইপ্রাস থেকে দক্ষিণ সাইপ্রাসে আসার সময় দালালেরা তার পাসপোর্টটি কেড়ে নিয়েছে৷ আশ্রয়ের আশায় গত ছয়দিন ধরে সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোসিয়ায় অবস্থিত পুরনারা ক্যাম্পে গেইটের সামনে অপেক্ষা করছেন তিনিসহ আরো দুজন বাংলাদেশি৷

কেন এভাবে অপেক্ষা করছেন জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘‘আমাদের ধারণা, সবাই বলে যে, বড় বড় স্যারেরা যখন আসবে তখন নেবে৷’’

সেলিম আসলে ক্যাম্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন৷ তার ধারণা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে পড়লে হয়তো এই ক্যাম্পটিতে আশ্রয় পাওয়া যাবে৷

পাসপোর্ট নেই কেন?

নিজের পাসপোর্টের মূলকপি কেন সাথে নেই এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম বললেন, দালালেরা নিয়ে গেছে৷ সেলিমের সাথে থাকা আরেক বাংলাদেশির এনামুল হকের দাবিও তাই৷

ক্যাম্পে বাস করছেন এমন বাংলাদেশিদের সাথে কথা বলেও একই খবর জানা গেছে৷ সাইপ্রাসের রাজধানীর এই ক্যাম্পটিতে দুইশরও বেশি বাংলাদেশি রযেছেন৷ তার আগে ডয়চে ভেলের সংবাদকর্মীদের সাথে কথা হয় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির৷ সকলেই জানালেন যে, তাদের পাসপোর্ট দালালেরা রেখে দিয়েছে৷

তাদের দাবি, উত্তর সাইপ্রাস থেকে চেক পয়েন্ট পাড়ি দিযে গ্রিস অধিকৃত সাইপ্রাসে আসার পথে দালালেরা তাদের পাসপোর্ট হাতিয়ে নেয়৷ যদিও কেন তারা পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি৷

যেভাবে প্রতারিত তারা

সাত লাখ টাকা খরচ করে বাংলাদেশ থেকে সাইপ্রাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন সেলিম৷

তিনি জানান, তাকে ও তার সহযাত্রী এনামুলকে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে দুবাই নিয়ে আসে দালালেরা৷ এরপর আরো কয়েকটি দেশে যাত্রা বিরতি শেষে তাদেরকে নিয়ে আসা হয় উত্তর সাইপ্রাসে৷ আর সেখান থেকে দালালেরা তাদের ঠেলে দেয় দক্ষিণ সাইপ্রাসে৷

কোন কোন দেশ হয়ে নিয়ে আসা হয়েছে এ দুই অভিবাসন-প্রত্যাশী তা ঠিক বলতে পারেননি৷ শুধু এটুকুই বলতে পারলেন, মোট তিনটি যাত্রা বিরতি নিয়েছিলেন তারা৷

ভাল কাজের সন্ধানে দেশ ত্যাগ করা সেলিমদের দুর্ভোগের গল্পটি অবশ্য এখানেই শেষ নয়৷ সাইপ্রাসে কী ধরনের কাজ তারা করবেন সে বিষয়েও ধোকা দেওয়া হয় তাদের৷

ডয়চে ভেলেকে সেলিম বলেন, ‘‘আমাকে বলা হয়েছিল আপেল বাগান বা রেস্টুরেন্টে কাজ দেওয়া হবে৷ ক্যাম্পে থাকতে হবে তা আমাকে বলা হয়নি৷’’

তার আগে যখন ডয়চে ভেলের সাংবাদিকদের কাছে প্রতারিত হওয়ার কথা জানান এই ক্যাম্পে থাকা আরো কয়েকজন বাংলাদেশি৷

তাদেরই একজন বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার ফিরোজ মৃধা৷ গত এক মাস ধরে সাইপ্রাসের নিকোসিয়ায় অবস্থিত পুরনারা শরণার্থী ক্যাম্পে আছেন তিনি৷ বাংলাদেশ থেকে আরব আমিরাত হয়ে সাইপ্রাসে এসেছেন তিনি৷ তাকেও এখানে নিয়ে এসেছেন দালালেরা৷ আর এই পর্যন্ত আসতে তার খরচ হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ টাকা৷

তার দাবি, কয়েক লাখ টাকা খরচ করে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি দেশ ছেড়েছেন, সাইপ্রাসে এসে দেখেন এর সবই মিথ্যা৷

তাকে বলা হয়েছিল, ওয়ার্কশপে কাজ দেওয়া হবে আর আয় হবে এক হাজার ইউরোর অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক লাখ টাকা৷ সেই সাথে প্রতি মাসে তিনশ ইউরো অর্থাৎ প্রায় ৩০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন তিনি৷ আর এসব মিলিয়ে তার মাসিক আয় হবে এক লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো৷

কিন্তু এই টাকা আয় তো দূরের কথা, এখন তার ঠিক মতো মাথা গোঁজার ঠাঁই-ই মিলছে না৷

অবশ্য ফিরোজ মৃধার মতো আরো কয়েকজন অন্তত রাত কাটানোর ঠাঁইটুকু পেয়েছেন৷ কিন্তু সেলিম ও তার সাথে থাকা আর দুই বাংলাদেশির সেই সম্বলটুকুও নেই৷প্রচণ্ড রোদে লাল রঙের একটি গামছা মাথায় আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে আশ্রয় পাওয়ার আশায় থাকা সেলিম জানেন না কবে তার জন্য এই ক্যাম্পটিতে জায়গা মিলবে৷ শুধুমাত্র আশাকে সম্বল করেই তিনি হয়েতো প্রতিদিন সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থাকবেন ক্যাম্পের সামনে৷