সাড়ে ১০ কোটির গাড়ি সোয়া কোটিতে আনলেন সাকিব, আটকে গেলো সুমনেরটা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ৫০ জন সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেছেন। তবে সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় ৪৩টি গাড়ির খালাস আটকে দিয়েছে কাস্টমস। সাতটি গাড়ি ৬ আগস্টের আগেই খালাস করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি গাড়ি দুটি ছিল ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন ও সাকিব আল হাসানের। সাকিবেরটা আগেই ছাড় করতে পারলেও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছেন না ব্যারিস্টার সুমন।
খালাসের অপেক্ষায় থাকা গাড়িগুলোতে আমদানিকারকরা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবেন না বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তারা। স্বাভাবিক হারে শুল্ককর পরিশোধ করেই এসব গাড়ি খালাস করতে হবে। স্বাভাবিক হিসাবে আমদানি করা এসব গাড়ির সিসি অনুসারে শুল্কায়ন মূল্যের ৮১০ থেকে ৮২৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক পরিশোধ করতে হবে আমদানিকারকদের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর পরের দিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন দ্বাদশ সংসদ ভেঙে দেন। এতে ওই সংসদের সদস্যরা অন্য সুযোগ-সুবিধার মতো শুল্কমুক্ত গাড়ি পাওয়ার সুবিধাও হারান।
শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা যেসব গাড়ি এরই মধ্যে খালাস হয়েছে তা ৬ আগস্টের আগেই শুল্কায়ন করা। এতে গাড়িগুলো খালাসকালে আটক করার আইনানুগ সুযোগ ছিল না। তবে ৬ আগস্ট বিগত জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পরে যেসব গাড়ি আমদানি হয়েছে, তাতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাস দেওয়ার সুযোগ নেই।- চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান
সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরে এবং আগে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা সাতটি গাড়ির খালাস দেয় কাস্টমস। তবে বিআরটিএ থেকে এসব গাড়ি এখনো রেজিস্ট্রেশন পায়নি। পাশাপাশি অবশিষ্ট ৪৩টি গাড়ি চট্টগ্রাম বন্দর, মংলা বন্দর এবং কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) রয়েছে। আমদানিকারকের পক্ষে খালাসের দায়িত্বে ছিলেন গোল্ডেন স্টার এজেন্সি, চেরি এন্টারপ্রাইজ, নাভানা লিমিটেডসহ ছয়টি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান।
খালাস হয়েছে যাদের গাড়ি:
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র জানায়, মাগুরা-১ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, নাটোর-১ আসনের স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত আবুল কালাম, বগুড়া-৫ আসনের মজিবর রহমান মজনু, লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের মোহাম্মদ গোলাম ফারুক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের ফয়জুর রহমান এবং সিরাজগঞ্জ-২ আসনের জান্নাত আরা হেনরী এরই মধ্যে গাড়ি খালাস নিয়েছেন। আরও কয়েকজন খালাসের জন্য কাস্টমসের অটোমেশন সার্ভার এসাইকুডা ওয়ার্ল্ডে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেছেন।
এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা গাড়ির মধ্যে বেশির ভাগই টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো এবং টয়োটা এলসি স্টেশন ওয়াগন। জাপান ও সিঙ্গাপুর থেকে এসব গাড়ি আসে বাংলাদেশে। এসব গাড়ির ইঞ্জিন ক্যাপাসিটি তিন থেকে চার হাজার সিসি।
সংসদ সদস্যরা প্রতি পাঁচ বছরে একবার শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারেন। এ ধরনের গাড়ির ওপর কর ৮১০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। তবে এমপিদের তা দিতে হয় না। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়নি।
আটকে গেছে ৪৩ সাবেক এমপির গাড়ি:
শুল্কমুক্ত সুবিধা নিতে গাড়ি আমদানিকারক অন্যরা হলেন চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মোতালেব, সুনামগঞ্জ-১ আসনের রণজিত কুমার সরকার, ময়মনসিংহ-৭ আসনের এ বি এম আনিছুজ্জামান, নীলফামারী-৩ আসনের সাদ্দাম হোসেন পাভেল, টাঙ্গাইল-৮ আসনের অনুপম শাহজাহান জয়।
গাইবান্ধা-২ আসনের শাহ সরোয়ার হাসান, নেত্রকোণা-৪ আসনের সাজ্জাদুল হাসান, হবিগঞ্জ-৪ আসনের ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান (স্বতন্ত্র), চট্টগ্রাম-৪ আসনের সাবেক এস এম আল মামুন, রাজশাহী-৪ আসনের আবুল কালাম আজাদ, গাজীপুর-৫ আসনের আখতারুজ্জামান, ঝালকাঠি-১ আসনে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ শাহজাহান ওমর, ঢাকা-১৯ আসনের সাইফুল ইসলাম, ময়মনসিংহ-১১ আসনের মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ, ঢাকা-১০ আসনের চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ।
এছাড়া আরও আছেন- সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের চয়ন ইসলাম, ঢাকা-১৭ আসানের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, ঝিনাইদহ-২ আসনের নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল, খুলনা-৩ আসনের এস এম কামাল হোসেন, নীলফামারী-৪ আসনের মোহাম্মদ ছিদ্দিকুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ-৪ আসনের ড. মোহাম্মদ সাদিক, রাজশাহী-৩ আসনের মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, হবিগঞ্জ-২ আসনের ময়েজ উদ্দিন শরীফ, চাঁদপুর-২ আসনের মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, ময়মনসিংহ-৮ আসনের মাহমুদ হাসান সুমন।
সাতক্ষীরা-৪ আসনের এস এম আতাউল হক দোলন, ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন, ময়মনসিংহ-১ আসনের মাহমুদুল হক সায়েম, বগুড়া-৪ আসনের জাসদের এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন, লালমনিরহাট-৩ আসনের মতিয়ার রহমান এবং যশোর-২ আসনের মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামান।
এছাড়া সংরক্ষিত নারী আসনের বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, সংরক্ষিত মহিলা আসন-০৭ এর সংসদ সদস্য রুনু রেজা, খালেদা বাহার বিউটি (আসন-১০), নাদিয়া বিনতে আমিন (আসন-১৩), বেগম মাহফুজা সুলতানা (আসন-১৪), শাহিদা তারেক দিপ্তী (আসন-২৭), নাট্য অভিনেত্রী তারানা হালিম (আসন-৩১), নাছিমা জামান হেনরী (আসন-৪৫)।
সবচেয়ে দামি গাড়ির সুমনের, কম নাসিমা জামান ববির
এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি দামের গাড়ি আমদানি করেছেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তার ব্যাংক ঋণপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তিনি একটি গাড়ি আমদানির জন্য ১ লাখ ১১ হাজার ডলারের এলসি খোলেন। প্রতি ডলার ১১৯ টাকা ৪৮ পয়সা হিসেবে ওই গাড়ির আমদানিমূল্য পড়েছে এক কোটি ৩২ লাখ ৬২ হাজার ২৮০ টাকা। শুল্ককরসহ এ গাড়ির দাম পড়বে প্রায় ১১ কোটি টাকা।
অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা নিজের গাড়ি খালাস করে নিয়েছেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সিঙ্গাপুরের টয়োটা স্টোশু এশিয়া প্যাসিফিক পিটিই লিমিটেড থেকে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা মূল্যের টয়োটা এল সি স্টেশন ওয়াগন জিআর-এস মডেলের গাড়িটি আমদানি করেন। গাড়িটি ৩৩৪৬ সিসির। সাকিব আল হাসানের পক্ষে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নাভানা লিমিটেড গাড়িটি খালাসের জন্য কাস্টমসে নথি দাখিল করেন। শুল্কমুক্ত সুবিধা না থাকলে এ গাড়িটির স্বাভাবিক শুল্ককর হার ৮২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। যার দাম পড়তো ১০ কোটি ৪৯ লাখ টাকার বেশি।
শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা গাড়ির মধ্যে সবচেয়ে কম দামের গাড়িটি আমদানি করেন সংরক্ষিত নারী আসন-৪৫ এর নাসিমা জামান ববি। তিনি ৩০ হাজার ডলারের ঋণপত্র খোলেন ব্যাংকে। যা বাংলাদেশি টাকায় ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ৪শ টাকা।
এছাড়া শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে ১ কোটি ২৭ লাখ জাপানি ইয়েনে ঋণপত্র খোলেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, নাট্যাভিনেত্রী তারানা হালিম এবং লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন। যা বাংলাদেশি টাকায় ১ কোটি ৫ লাখ ৪১ হাজার টাকা (প্রতি ইয়েন দেশিয় মুদ্রায় ৮৩ পয়সা হিসেবে)।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান বলেন, ‘শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা যেসব গাড়ি এরই মধ্যে খালাস হয়েছে তা ৬ আগস্টের আগেই শুল্কায়ন করা। এতে গাড়িগুলো খালাসকালে আটক করার আইনানুগ সুযোগ ছিল না। তবে ৬ আগস্ট বিগত জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পরে যেসব গাড়ি আমদানি হয়েছে, তাতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাস দেওয়ার সুযোগ নেই। এ গাড়িগুলো নিয়ম অনুযায়ী সব শুল্ককর পরিশোধ করে খালাস নিতে হবে
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন