সাতক্ষীরায় শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা মামলা
বিএনপির সাবেক এমপি হাবিবসহ ৪ জনের যাবজ্জীবন ও ৪৪ জনের ৭ বছর করে কারাদণ্ড
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার দুটি মামলার রায় ঘোষণা করেছে সাতক্ষীরা স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক বিশ্বনাথ মন্ডল।
ওই মামলার অস্ত্র ও বিষ্ফোরক দ্রব্য আইনের পৃথক দুটি অংশের প্রত্যেকটিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি, সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিব, উপজেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের বাচ্চু, পৌর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান রনজু ও সাবেক ছাত্রদল নেতা আরিফুর রহমান রিপনকে যাবজ্জীবন এবং অপর ৪৪ জন আসামীর প্রত্যেককে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
রায় ঘোষণার সময় আসামীদের মধ্যে একই ঘটনা থেকে উদ্ভুত অপর একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে থাকা ৩৭ জন ও জামিনে মুক্তি পাওয়া একজন আদালতে হাজির ছিলেন। অন্যান্য আসামীরা পলাতক রয়েছে।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার দন্ডবিধি অংশে ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৫০ জন নেতা-কর্মীকে চার থেকে ১০ বছর মেয়াদে সাজা প্রদান করেন সাতক্ষীরার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবির।
আসামীদের মধ্যে মাহফুজুর রহমান সাবু ও জাবিদ রায়হান লাকি নামের দুইজন দন্ড ভোগ করা অবস্থায় কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।
এদিকে, মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) যখন আসামিদের আদালত থেকে বের করে প্রিজনভ্যানে তোলা হচ্ছিলো তখন আদালত চত্বরে বিক্ষোভ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা। মুহুর্মুহু স্লোগানে সাবেক এমপি হাবিবের প্রতি সমর্থন জানান দেন তারা। সেসময় পুলিশ সেখান থেকে জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মমতাজুল ইসলাম চন্দনসহ কয়েকজনকে আটক করে নিয়ে যায়।
এর পরপরই সেখানে পাল্টা মিছিল করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার দুটি মামলার রায় ঘোষণা
সাবেক এমপি হাবিবসহ চার জনের যাবজ্জীবন ও ৪৪ জনের সাত বছর কারাদন্ড
মামলায় সাজাপ্রাপ্ত অন্যান্য আসামীরা হলেন- কলারোয়া উপজেলা কৃষক দলের সভাপতি আশরাফ হোসেন (৪৫), উপজেলা মৎস্যজীবী দলের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম (৪৬), বিএনপি নেতা আব্দুর রাজ্জাক (৪৮), উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ তামিম আজাদ মেরিন (৪৫), উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল রকিব মোল্যা (৪৩), কলারোয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা গাজী আক্তারুল ইসলাম (৩৮), বিএনপি নেতা মফিজুল ইসলাম (৪৪), পৌর ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল মজিদ (৩০), বিএনপি নেতা এড. আব্দুস সামাদ (৫২), বিএনপি নেতা হাসান আলী (৪৫), উপজেলা কৃষকদলের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন আলী (৫৫), বিএনপি নেতা ময়না (৩৮), বিএনপি নেতা শিক্ষক আব্দুস সাত্তার (৫০), সাবেক উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মজ্ঞুর রোমেল (৪২), বিএনপি নেতা কলেজ শিক্ষক তোফাজ্জেল হোসেন সেন্টু (৫০), যুবদল নেতা মাজাহারুল ইসলাম (৪৫), বিএনপি নেতা আব্দুল মালেক (৩৮), বিএনপি নেতা আব্দুর রব (৪৬), উপজেলার কেরালকাতা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম (৪৩), যুগীখালী ই্উপি চেয়ারম্যান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম (৫০), পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রসুল (৪৮), সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিএনপি নেতা এড. আব্দুস সাত্তার (৫২), যুবদল নেতা রিংকু (৩২), যুবদল নেতা আব্দুস সামাদ (৪৮), বিএনপি নেতা আলাউদ্দীন (৩৪), যুবদল নেতা আলতাফ হোসেন (৩৮), উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি তাওফিকুর রহমান সনজু (৩৩), ছাত্রদলের সাবেক সহ.সভাপতি নাজমুল হোসেন (৩০), বিএনপি নেতা সাহাবুদ্দিন (৪৯), বিএনপি নেতা সাহেব আলী (৪৮), বিএনপি নেতা সিরাজুল ইসলাম (৫৫), শ্রমিকদল নেতা টাইগার খোকন (৩৮), শ্রমিকদল নেতা ট্রলি সহিদুল (৪২), বিএনপি নেতা কনক (৩৮), পৌর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শেখ কামরুল হোসেন (৫০), যুবদল নেতা মনিরুল ইসলাম (৩০), যুবদল নেতা ইয়াছিন আলী (৩৫), পৌর বিএনপির সহ.সভাপতি আখলাকুর রহমান শেলী (৩২), বিএনপি নেতা শাহিনুর রহমান (৫২), বিএনপি নেতা বিদার মোড়ল (৪০), যুবদল নেতা সোহাগ হোসেন (২৮), বিএনপি সমর্থক মাহাফুজার রহমান মোল্যা (৩৮), জামায়াত কর্মী গফ্ফার গাজী (৪০), সাবেক উপজেলা যুবদলের সহসভাপতি মাহাফুজুর রহমান সাবু (৫০)।
এদের মধ্যে মাহাফুজুর রহমান সাবু ও লাকি কারাগারে থাকাকালিন মারা গেছেন।
অপর আসামীদের মধ্যে নাজমুল হোসেন, মোঃ আলাউদ্দিন, আব্দুল কাদের বাচ্চু, রিপন, মফিজুল ইসলাম, খালেদ মঞ্জুর রোমেল, মাজাহারুল ইসলাম, আব্দুল মালেক ও রবিউল ইসলাম পলাতক রয়েছেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা কলারোয়া উপজেলার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলদী গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে দেখতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আসেন। সেখান থেকে যশোরে ফিরে যাওয়ার পথে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে রাস্তার উপর জেলা বিএনপি’র সভাপতি ও তৎকালিন সাংসদ হাবিবুল ইসলামের হাবিব ও বিএনপি নেতা রঞ্জুর নির্দেশে বিএনপি ও যুবদলের নেতা কর্মীরা দলীয় অফিসের সামনে একটি যাত্রীবাহি বাস (সাতক্ষীরা-জ-০৪-০০২৯) রাস্তার উপর আড় করে দিয়ে তার গাড়ি বহরে হামলা চালান। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমানকে গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে মারপিট করা হয়। তার কাছে থাকা সাড়ে ১১হাজার টাকা ছিনতাই করা হয়। মারিপট করে জখম করা হয় নেত্রীর গাড়ি বহরে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল হক রাসেল, রমনা এলাকার যুব মহিলা লীগের নেত্রী ফতেমা জামান সাথী, আওয়ামী লীগ কর্মী আব্দুল মতিনসহ কয়েকজন। এ সময় কয়েকজন সাংবাদিক থানার ভিতরে আশ্রয় নিলেও তাদেরকেও পিটিয়ে জখম করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় তাদের ক্যামেরা। ছিনিয়ে নেওয়া হয় মোবাইল, ঘড়ি ও টাকা।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরের ঢাকা মেট্রো-গ-১২-৫৩৪২ পাজেরু গাড়িটি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় কলারোয়া থানা মামলা না নেওয়ায় ২ সেপ্টেম্বর কলারোয়া উপজেলা (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোসলেমউদ্দিন বাদি হয়ে ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৭০/৭৫ জনকে সাতক্ষীরা নালিশী আদালত ‘ক’ অঞ্চলে একটি মামলা (সিআরপি-১১৭১/০২) দায়ের করেন। মামলায় ১৮জনকে সাক্ষী করা হয়। বিচারক এম আই ছিদ্দিকী তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম গোলাম কিবরিয়াকে নির্দেশ দেন। তদন্তকারি কর্মকর্তা ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঘটনা মিথ্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
বাদি মোসলেম উদ্দিন পুলিশ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ২২ জানুয়ারি আদালতে নারাজির আবেদন জানালে শুনানী শেষে তা খারিজ হয়ে যায়। এ খারিজ আবেদনের বিরুদ্ধে বাদি ২০০৪ সালের ১১ এপ্রিল জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা (১৭/০৪) দায়ের করেন। ২২ এপ্রিল শুনানী শেষে বিচারক একেএম জহিরউদ্দিন এ রিভিশন আবেদন খারিজ করে দেন। নিরুপায় হয়ে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট বাদি এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে ক্রিমিনাল মিস কেস (৫৮৯৩/০৪) দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানী শেষে বিচারক এম এনায়েতুর রহিম ও আকরাম হুসাইন চৌধুরী ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই আপিল মঞ্জুর করে নি¤œ আদালতের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ দেন। একইসাথে নি¤œ আদালতে মামলার কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। আদেশের কপি দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর ফাইলবন্দি থাকার পর ২০১৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এসে পৌঁছায়।
১৭ সেপ্টেম্বর বাদির উপস্থিতিতে নারাজি শুনানী করার জন্য মুখ্য বিচারিক হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা ১৫ অক্টোবর ২০১৪ দিন ধার্য করেন। ওই দিন বিচারক শুনানী শেষ অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। ওই দিনই মামলাটি থানায় রেকর্ড হওয়ার পর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) শফিকুর রহমানকে তদন্তকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাড়ে ছয় মাস পর ২০১৬ সালের ৪ মে তিনি আদালতে ৫০ জনের নামে এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ৭ মে আদালতে অভিযোগপত্রটি গৃহীত হয়। ২০১৬ সালের ৭ জুন অভিযোগপত্রে উল্লেখিত সকল আসামীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৭, ১৪৮, ৩২৩, ৩০৭, ৩৫৪, ৩৭৯, ৪০৯, ৪২৭, ৫০০ ও ৫০৬(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগপত্রে নাবালক রকীবের নাম রাখায় আসামীপক্ষ মহামান্য হাইকোর্টে যেয়ে কার্যক্রম স্থগিত করেন।
২০১৯ সালে মামলাটির দন্ডবিধির অংশ নতুন করে সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এলে ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্রে উল্লেখিত ৫০জন আসামীকে চার থেকে ১০ বছর মেয়োদে সাজা দেওয়া হয়।
অপরদিকে মামলার অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের এসটিসি ২০৭/১৫, ২০৮/১৫ এ দু’টি মামলায় ১৫ জন সাক্ষী দেন। স্বাক্ষী চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষে অবস্থানকারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এসএম মুনিরকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় সাতক্ষীরা জজ কোর্টের পিপি এড. আবদুল লতিফের সদর থানার সাধারণ ডায়েরীর তদন্তে বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ১০জনের বিরুদ্ধে নন জিআর মামলা দায়ের করা হয়। যা আজো চলমান।
যুক্তিতর্ক শেষে সাতক্ষীরার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক বিশ্বনাথ মন্ডল মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন