সারাদেশে ভোটগ্রহণ শুরু
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। তিনশ’ আসনের মধ্যে ২৯৯টিতে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে।
এবারের ভোটে দেশের সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে ভোট গ্রহণের সব প্রস্তুতি।
এ নির্বাচনে ভোটাররা দেশ শাসনের গণরায় দেবেন আজ। তাদের এ রায়ে নির্ধারিত হবে আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি কোন রাজনৈতিক দল বা জোট সরকার গঠন করছে। গণরায় জানাতে ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার আহবান জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
প্রার্থী মারা যাওয়ায় গাইবান্ধা-৩ আসনে আজ ভোট হচ্ছে না। এ আসনে আগামী ২৭ জানুয়ারি ভোটের পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।
দীর্ঘ দশ বছর পর সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়ায় তীব্র শীতেও সারা দেশে নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচন ঘিরে যেমন উৎসবের আবহ তৈরি হয়েছে, তেমনি শঙ্কাও কাজ করছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা শনিবার সংবাদ সম্মেলনে নির্ভয়ে কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভোটারদের নিরাপত্তা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের কর্মী, সমর্থক ও প্রার্থীদের ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মানুষের মনে অনেক সংশয় ও সন্দেহ রয়েছে। ভোটারদের সকাল সকাল কেন্দ্রে যাওয়ার আহবান জানিয়ে জোটটির পক্ষ থেকে বলা হয়, আপনারা ভয় পাবেন না। ভোটাররা কেন্দ্রে গেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যাবে।
এ নির্বাচনে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলই শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে টিকে আছে। এতে সবমিলিয়ে ১ হাজার ৮৬১ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের ১ হাজার ৭৩৩ জন ও বাকি ১২৮ জন স্বতন্ত্র। দীর্ঘ দশ বছর পর সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করায় প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও সারা দেশে নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে।
যদিও সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ ও পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন অনেকেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে ভোটের মাঠ অস্থির করার অভিযোগ তুলেছেন। এর পাশাপাশি কয়েকদিন ধরে সারা দেশে নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীরা সভা-সমাবেশের মাধ্যমে প্রচার চালিয়েছেন।
ইসি জানিয়েছে, ভোটের মাঠের নিরাপত্তায় রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৬ লাখ ৭৩ হাজার সদস্য। এর মধ্যে ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তায় থাকছেন ৬ লাখ ৮ হাজার সদস্য। ভোট গ্রহণ ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ভোটের সময় সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ে ইসিতে ‘আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় ও মনিটরিং’ সেল খোলা হয়েছে।
ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রায় এক দশক পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ২৭২ জন ও বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ২৮২ জন লড়ছেন। এর মধ্যে সরাসরি আওয়ামী লীগ দলীয় ২৬০ জন ও বিএনপির ২৫৭ জন প্রার্থী রয়েছেন।
দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা বাকিরা জোটভুক্ত শরিক দলের। এ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলে থাকা ৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ধানের শীষ প্রতীকে লড়ছেন। পক্ষান্তরে মহাজোট ও ১৪ দলীয় জোটে থাকা ৪টি দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে মাঠে রয়েছেন। কারাগারে থাকায় এবারই প্রথম বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভোটে অংশ নিতে ও ভোট দিতে পারছেন না।
এর আগে সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নিয়েছিল। এরপর তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল বর্জন করে।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ ১২টি দল অংশ নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২০০৮ সালের পর এবার নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়ায় দেশ ও বিদেশে এ নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। সুষ্ঠু ও নির্ভয়ে ভোটগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। ইতিমধ্যে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকরা এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন।
৮ নভেম্বর এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিএনপি, যুক্তফ্রন্টসহ কয়েকটি দলের দাবির মুখে পুনঃতফসিল ঘোষণা করে ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী মারা যাওয়ায় গাইবান্ধা-৩ আসনে আগামী ২৭ জানুয়ারি ভোটের পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।
জানা গেছে, নানান ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে টানা ১৯ দিন প্রচার চালিয়েছেন প্রার্থীরা। প্রচার ঘিরেই মূলত উৎসবের আবহ তৈরি হয়। শুক্রবার সকাল ৮টার পর থেকে সব ধরনের প্রচার বন্ধ রয়েছে। শনিবার দেশের সব ভোট কেন্দ্রে নির্বাচনী মালামাল পৌঁছে গেছে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আজ সকাল ৮টায় একযোগে ভোটগ্রহণ শুরু করবেন।
ভোটগ্রহণ কেন্দ্র করে গুজব ও প্রভাব বিস্তার বন্ধে মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোর-জি থেকে নামিয়ে টু-জি করা হয়েছে।
বন্ধ রাখা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। একইভাবে শনিবার মধ্যরাত থেকে আজ রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত সব ধরনের যানবাহন চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে কমিশনের অনুমোদিত পরিচয়পত্রধারীদের গাড়ি চলাচল করবে। পাশাপাশি হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসসহ জরুরি কাজে নিয়োজিত গাড়ি চলাচলে এ বিধিনিষেধ থাকছে না।
ইসি সূত্রে আরও জানা গেছে, এবার তিনশ’ আসনে মোট ভোটার রয়েছেন ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭। এতে ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোট কেন্দ্র ও ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি ভোটকক্ষ রয়েছে। এবারই প্রথম ছয়টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ করা হবে।
আসনগুলো হচ্ছে- রংপুর-৩, খুলনা-২, সাতক্ষীরা-২, ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩ ও চট্টগ্রাম-৯। এসব আসনের ৮৪৫টি কেন্দ্রের ৫ হাজার ৩৮ ভোটকক্ষে এ মেশিন ব্যবহার করা হবে। এ ছয়টি আসনে ভোটার সংখ্যা ২১ লাখ ২২ হাজার। যদিও এ মেশিন ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা : ইসি সূত্র জানিয়েছে, ভৌগোলিক ও অবস্থান বিবেচনায় ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এবারের নির্বাচনে মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরের সাধারণ কেন্দ্রগুলোতে ১৪ থেকে ১৫ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৬ জন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
এর মধ্যে সাধারণ কেন্দ্রে অস্ত্রসহ পুলিশ একজন, অস্ত্রসহ অঙ্গীভূত আনসার ১ জন, লাঠি বা অস্ত্রসহ অঙ্গীভূত আনসার ১ জন, সাধারণ আনসার ১০ জন এবং গ্রামপুলিশ ১-২ জন রয়েছেন।
মেট্রোপলিটন এলাকার কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ওই সংখ্যা থেকে অস্ত্রধারী ১ জন করে বেশি রাখা হবে। পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল, হাওর এলাকার কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা আরও বেশি থাকবে। ভোট কেন্দ্রে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভোটগ্রহণের দুই দিন আগে মোতায়েন করা হয়েছে।
এক নজরে ভোটের তথ্য : ইসির তথ্য অনুযায়ী দেশের তিনশ’ আসনে ভোট কেন্দ্র ৪০ হাজার ১৮৩টি ও ভোটকক্ষ ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি। ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন।
এর মধ্যে পুরুষ ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ ও নারী ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ জন।
অংশগ্রহণকারী রাজনৈতি দলের সংখ্যা ৩৯টি। তবে জোটের আড়ালে বেশ কয়েকটি অনিবন্ধিত দলের নেতারা নিবন্ধিত দলের প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন।
এ নির্বাচনে সব মিলিয়ে প্রার্থী রয়েছেন ১ হাজার ৮৬১ জন; এর মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের ১ হাজার ৭৩৩ জন ও স্বতন্ত্র ১২৮ জন।
ভোটের নিরাপত্তায় প্রায় সাত লাখ সদস্য : এ নির্বাচনের নিরাপত্তায় প্রায় সাত লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসি। এতে সেনা সদস্যসহ নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৬ লাখ ৭৩ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্যে ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন ৬ লাখ ৮ হাজার ও বাকি ৬৮ হাজার ৬১০ জন কেন্দ্রের বাইরে স্ট্রাইকিং ফোর্স, মোবাইল টিমসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবেন।
ভোট কেন্দ্রে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর মধ্যে পুলিশ এক লাখ ২১ হাজার, আনসার ৪ লাখ ৪৬ হাজার, গ্রামপুলিশ ৪১ হাজার সদস্য রয়েছেন।
আর ভোট কেন্দ্রের বাইরে মোতায়েন করা বাহিনীর মধ্যে ৩৮৯টি উপজেলায় সেনাবাহিনী ৪১৪ প্লাটুন (১২ হাজার ৪২০ জন), নৌবাহিনী ১৮ উপজেলায় ৪৮ প্লাটুন, কোস্টগার্ড ১৮ উপজেলায় ৪৮ প্লাটুন (এক হাজার ২৬০ জন)/বিজিবি ৯৮৩ প্লাটুন (২৯ হাজার ৪৯০ জন); র্যাব ৬০০ প্লাটুন (১৮ হাজার) এবং মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স দুই হাজার প্লাটুন (প্রায় ৬৫ হাজার)।
এছাড়া নির্বাচনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৬৪০ জন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এক হাজার ৩২৮ জন (এর মধ্যে ৬৫২ জন আচরণ বিধি প্রতিপালনের জন্য) মাঠে রয়েছেন।
রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা : দেশের সব সংসদীয় আসনের নির্বাচন শেষ করতে ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে।
এর মধ্যে ৬৪ জেলায় সমসংখ্যক এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুই বিভাগীয় কমিশনার এ দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সহায়তা করতে ৫৮২ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন।
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক : এ নির্বাচনে ওআইসি, কমনওয়েলথসহ কয়েকটি সংস্থার ইসির আমন্ত্রিত ও স্বেচ্ছায় ৩৮ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক এসেছেন। এছাড়া কূটনৈতিক ও বিদেশি মিশনের ৬৪ কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের দূতাবাস, হাইকমিশন ও বিদেশি সংস্থায় নিয়োজিত ৬১ জন বাংলাদেশি কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।
অপরদিকে দেশীয় ৮১টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ৩৪ হাজারের বেশি পর্যবেক্ষক আবেদন করলেও অনুমোদন দেয়া হয়েছে ২৫ হাজার ৯০০ জনকে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন